কতগুলো ‘অস্বস্তি'!
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮নির্বাচন নিয়ে নানা খবর প্রচার হচ্ছে৷ হয়েছে৷ এর মধ্যে চোখ আটকে গেল একটি ইংরেজি দৈনিকের খবরে৷
খবরটি হলো, খুলনা-১ আসনে প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, মোট ভোটার সংখ্যার চেয়ে ২২ হাজার ভোট বেশি গণনা করা হয়েছে৷ তা কীভাবে সম্ভব?
মোট ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪শ' ২০টি ভোটের মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬শ' ৬৯টি ভোট পেয়েছেন নৌকা মার্কার প্রার্থী এবং ২৮ হাজার ১শ ৭০টি ভোট পেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী৷ পরে অবশ্য সেটি ঠিক করে আবার ফলাফল ঘোষণা করা হয় বলে পত্রিকাটি জানায়৷ এদিকে, পরে এ খবর ‘অসত্য’ দাবি করে তা প্রকাশের অভিযোগে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে৷
ফলাফল কী হলো, কে জিতল, কতটা ভোট জালিয়াতি হলো, কতটা সুষ্ঠু হলো এমন নানা প্রশ্নে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক৷
আওয়ামী লীগের বিরাট এই জয়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই৷ কিন্তু অনেককেই দেখলাম ফেসবুকে এ নিয়ে নানান রকমের সমালোচনা তুলে ধরতে৷ এক সাংবাদিককে দেখলাম লিখেছেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন বিলুপ্তির দাবি জানাই৷'' তিনি লিখেছেন, ‘‘যেহেতু উন্নয়ন প্রয়োজন, তাই গণতন্ত্রকে আগামী ৫০ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো যেতেই পারে৷''
গুরুতর অসন্তোষ৷ অধিকাংশ টিভি চ্যানেল দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে, নির্বাচন মোটা দাগে সুষ্ঠু হয়েছে, কিছু ব্যত্যয় ছাড়া৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাতেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে৷ অনেকেই অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগ শুনেছেন ভোটারদের কাছে৷ তবে একজন সাংবাদিকের পক্ষে কতগুলো কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব? তাই কয়েকটি কেন্দ্র দিয়ে হয়তো ‘পুরো দেশের চিত্র' সাধারণীকরণ করা সম্ভব না৷ কিন্তু সবার অভিজ্ঞতা মেলালে আবার একটি বড় চিত্র পাওয়া যায়৷ সে যা-ই হোক, কিছু বিষয় আমাকে চরম অস্বস্তিতেফেলেছে৷
১. ইন্টারনেট বন্ধ
এই যুগে আমরা মোবাইলের ওপর যতটা, তার চেয়ে বেশি মোবাইলের ডেটার ওপর নির্ভরশীল৷ তাই নির্বাচনের আগে- পরের সময়টুকুতে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এক রকম বিপদে পড়তে হয়েছে অনেককেই৷ উদ্দেশ্য মহৎ ছিল হয়তো৷ গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে হবে৷ কিন্তু মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলাটা কোনোকালেই যে সমাধান নয়, তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে৷ ইন্টারনেটের কারণে অনেকটা অস্বস্তিতে থেকেছেন মানুষ৷
২. রাস্তাঘাট অচল
দ্বিতীয় যে কারণটি মানুষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে, তা হলো রাস্তাঘাটের অচলাবস্থা৷ এটিও ‘নিরাপত্তার কারণে'৷ কোনো মোটরচালিত যানবাহন স্টিকার ছাড়া চলতে পারবে না৷ একজন অসুস্থ মানুষকে যদি জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতাল ব্যতীত অন্যকোথাও যেতে হয়, বা অন্তত নিজের ভোটটি দিতেও যেতে হয়, তাহলে নিশ্চয় তিনি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করবেন না৷ তার মানে তিনি হয়তো ভোট দিতেই যাননি৷
৩. অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচনের আগের দিন থেকে রাস্তায় এতটা নিরাপত্তা দেখে বিদেশি বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘এত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন?'' তাদের এই প্রশ্ন আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে৷ আমি বলেছি, নির্বাচনে সাধারণত আমাদের দেশে সহিংসতা একটি সাধারণ ব্যাপার৷ এবার যেন তা কম হয়, তার জন্য হয়তো এই ব্যবস্থা৷ কিন্তু এতটা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জনমনে আরো নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কার জন্ম দেয় কিনা তা ভাবতে হবে৷
৪. পুলিশের ভূমিকা
নির্বাচন কমিশনের দেয়া গাইড লাইন অনুযায়ী কাজ করতে গিয়েও ভোটের দিন কেন্দ্রগুলোতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন সাংবাদিকরা৷ আমি ব্যক্তিগতভাবেও হয়েছি৷ বাধা দিয়েছে পুলিশ৷ প্রিজাইডিং অফিসাররা যেখানে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকার কথা, সেখানে পুলিশ গেট থেকেই বলছে, ‘‘আপনারা ঢুকতে পারবেন না৷'' এটা কেমন গণতন্ত্র? যদিও পরে প্রিজাইডিং অফিসারদের মধ্যস্থতায় ভেতরে ঢোকা গেছে, কিন্তু বাধার কারণ বোধগম্য হচ্ছিল না৷ বিভিন্ন পত্রিকার সতীর্থ সাংবাদিকদের কাছ থেকেও এমন অভিজ্ঞতা শোনা গেছে৷
৫. পেশিশক্তি প্রয়োগের অভিযোগ
স্থানীয় সাংবাদিকরা তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, কোথাও কোথাও ভোট প্রয়োগ করতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো ভোটার৷ বিবিসির একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আগেই নৌকার সিল মারা ছিল এমন ব্যালট বই৷ সহিংসতার কতগুলো চিত্র তো দেখাই গেছে৷ এগুলো সরকারি দল ও বিরোধী পক্ষের মধ্যকার ভোটকেন্দ্র দখল নিয়েই বেশিরভাগ৷
৬. অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের অভিযোগ
অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছিল বেশ কিছু৷ যেমন, অনেক ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গিয়েও ভোট দিতে পারেননি৷ তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ কিংবা তাঁরা কেন্দ্র খুঁজে পাচ্ছেন না৷ এই অবস্থা তো হবার কথা নয়৷ আবার একজন অভিযোগ করলেন, মুখ চিনে ভোট দিতে দেয়া হচ্ছে৷ কারা করছেন? উত্তর দিলেন না৷ অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভোটার অভিযোগ করলেন, লাইনের বাইরে থেকে লোক ঢুকে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন৷ প্রিজাইডিং কর্মকর্তা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করলেন৷
৭. বিরোধী কর্মীদের অনুপস্থিতি
যে কয়টি কেন্দ্রে গিয়েছি, সবখানেই রাস্তার ওপর থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শুধু সরকারি দলের কর্মীদেরই উপস্থিতি৷ বিরোধী কর্মীরা কেন আসেননি তা নিয়ে অভিযোগ-পালটা অভিযোগ আছে৷ কিন্তু তারা না থাকাতে সেটি দেখতে ভালো লাগেনি৷ যে কারো মনেই প্রশ্ন জাগবেই যে, একচেটিয়া নির্বাচন হচ্ছে কি? আবার অনেক কেন্দ্রেই ছিলেন না বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টরা৷ তাই সেসব কেন্দ্রে কোনো অনিয়ম হলে প্রতিবাদ জানানোর কেউ ছিলেন না৷ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এটিও অস্বস্তির ব্যাপার৷
শুরুতেই বলেছি, আমি সার্বিকভাবে নির্বাচন ও এর ফলাফল কী হতে পারতো, কী হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না৷ কিন্তু এই খণ্ডচিত্রগুলো জাতিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে৷ তাই কেউ প্রশ্ন তুললে একেবারে খারিজ করে দেবার সুযোগ নেই৷
যুবায়ের আহমেদের লেখাটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷