নারীর হয়রানির শিকার যখন নারী
১৪ জুলাই ২০২০অভিযোগ, নারী চিকিৎসক বলেছেন, ‘‘রেপ করে দিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে!’’
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখানে নারী বা পুরুষ বিষয় নয়, নারীকে যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের পিছনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই কাজ করছে৷ আর সেক্ষেত্রে কোনো নারীর আরেক নারীর প্রতি নির্যাতনমূলক আচরণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মেই ব্যাখ্যা করতে হবে৷
শনিবার ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার ‘ভ্যাজাইনিসমাস’ সমস্যা নিয়ে গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. কাজী শামসুন নাহারের কাছে গিয়ে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ মা-কে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন ওই তরুণী৷ তার অভিযোগ অনুযায়ী, নানা শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক পর্যায়ে ওই চিকিৎসক তাকে বলেন, ‘‘এসব মেয়েদের হাজবেন্ড একটু জংলি টাইপের হওয়া উচিত, যাতে তারা একেবারে রেপ করে ফেলে৷ .... একেবারে রেপ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷’’
ওই ছাত্রী তার এক ফেসবুক পোস্টে এ কথা জানিয়ে ওই চিকিৎসককে বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন৷
স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছে৷ তাতে অভিযোগকে ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ তারা বলেছেন, চাইলে ওই ছাত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন৷
তবে ওই ছাত্রীর বাবা জালাল উদ্দিন কোনা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন না বলে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি, শব্দ বা ভাষা ব্যবহারে চিকিৎসক ভুল করেছেন৷ তার হয়রানির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না৷ আমার মেয়ে ওই ধরনের ভাষায় অপ্রস্তুত হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে৷’’
তবে চিকিৎসকদের ভাষার ব্যবহার এবং আচরণে আরো সংযমী এবং সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন৷
কিন্তু এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে হর-হামেশা ঘটলেও তার কোনো প্রতিকার দেখা যায় না৷ গত সোমবার করোনার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দেয়ার দায়ে গ্রেপ্তার হন জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী৷ সামাজি যোগাযোগ মাধ্যমে তার অপরাধ নিয়ে যত না আলোচনা, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তার ‘শরীর’ নিয়ে৷ শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি দিয়ে যৌন হয়রানিমূলক পোস্টও দেয়া হচ্ছে৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা একে বলেছেন, ‘ভার্চুয়াল রেপ’৷ তার মতে, সংবাদমাধ্যমও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই৷
গত বছর সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী শতকরা ৬৮ ভাগ নারী সাইবার অপরাধের শিকার হন৷ আর এই অপরাধের ১১টি ক্ষেত্র তারা চিহ্নিত করে৷ ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের হিসেবে এই অপরাধের যত মামলা হয়, তার প্রায় ৭০ ভাগের শিকার নারী৷ কিন্তু সেগুলো সংবাদমাধ্যমে আসে না৷ কারণ, অনেক নারীই সামাজিক কারণে তা প্রকাশ করতে চান না বা গোপন রাখেন৷ এর ফলে তাদের প্রতিকার পাওয়ার হারও খুবই কম৷
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, নারী যদি যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন, তাহলে তার ‘চরিত্র দোষ’ প্রমাণের সুযোগ আইনই করে দিয়েছে৷ ফলে নারীর ‘চরিত্র’ আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এখানে শুধু নারীর চরিত্রই নষ্ট হয়, পুরুষের হয় না৷ কাঠামোটাই পুরুষতান্ত্রিক৷ তার মতে, ‘‘অনেক চিকিৎসাযন্ত্র ও পদ্ধতি আছে, যার চরিত্রই পুরুষ তান্ত্রিক৷ স্কয়ার হাসপাতালের ওই নারী চিকিৎসক ছাত্রীটিকে যৌন হয়রানি করছেন৷ কিন্তু সেটা করেছেন তিনি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে৷’’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখে নারীর প্রতি সহিংসতা বা যৌন হয়রানি বন্ধ করা যাবে না৷ এখন নানাভাবে নারীদের হয়রানি করা হচেছ৷ অনলাইনে তাদের ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগে যত অভিযোগ আসে তার ৯০ ভাগই নারীদের হয়রানির অভিযোগ৷ আর এরমধ্যে আবার ৯০ ভাগ অপরাধের শিকার কিশোরীরা৷ নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘এই সমাজ এখনো নারীদের সম্মান করতে শেখেনি৷ নারীদের তারা ভোগের বস্তুই মনে করে৷ ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷ সবাই নারীকে নিয়ে ব্যবসা করতে চায়৷’’
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা মনে করেন, স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা একটি অপরাধ৷ এটাকে চিকিৎসা ব্যবস্থার সাধারণ প্রক্রিয়া বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা ডা. সাবরিনার গ্রেপ্তারের ঘটনায়ও দেখছি তার মূল অপরাধ নিয়ে তেমন আলেচনা নেই৷ আলোচনা চলছে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে৷ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য এটা হচ্ছে৷’’
গতবছর মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...