নাগরিক সমাজ কোথায়?
১৮ অক্টোবর ২০২১তাদের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ হিসেবে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবকে দায়ী করছেন তারা।
বুধবার কুমিল্লায় পুজা মণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয় তা এখনও শেষ হয়নি। রোববার গভীর রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুদের দুইটি গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত জানান,"এপর্যন্ত প্রায় ২০টি জেলায় প্রায় ৪২টি স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন চারজন।”
তিনি বলেন," হামলাকারীদের টার্গেট হলো মন্দির, মণ্ডপ এবং ঘরবাড়িতে হামলা, আগুন দেয়া, দোকানপাট লুট করা।”
এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় ১০ জেলার ২৮ মামলায় ৯ হাজার ৫২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ২২৯ জনকে।
লেখক এবং গবেষক আহসানুল কবীর জানান,"বুধবার মন্দিরের যে ঘটনা তা আমার বাড়ি থেকে এক মিনিটের পথ। কিন্তু শুধু আমি কেন, আমাদের এখানে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী কেউই তাদের রক্ষায় এগিয়ে যাইনি। আমরা প্রতিবাদও করিনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কুল্লিার মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়। এখানে দীর্ঘদিন ধরে একটা ভয়ের পরিবেশ কাজ করছে। ফলে এখন প্রকৃত অর্থে কোনো সিভিল সোসাইটি নেই। কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলেন না বা বলতে পারেন না। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আর সারাদেশের অবস্থা তো আপনারাই জানেন। সেটা কি আমাকে বলতে হবে!”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানও মনে করেন এবারের সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ম্রিয়মান। তারা যদি তাদের ভূমিকা পালন করতেন তাহলে হয়তো এতটা বিস্তৃত হতনা। তিনি মনে করেন,"মানুষ আইনের শাসনের দুর্বলতা দেখে, ত্রুটি দেখে দারুণভাবে হতাশ। আগে ছুটে যেত কারণ ছুটে যাওয়ার মধ্যে যে প্রতিবাদ তার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও রাষ্ট্রের কাছে প্রতিকার পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, যে দেশে বলা হয় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, সেই দেশে বাস্তবে আইনের কোনা গতিই নাই। মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তা কাজ করছে যে প্রতিবাদ করে কী হবে! কিছুই তো হচ্ছে না।”
তিনি বলেন," পক্ষান্তরে এইসব অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না। তারা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। সুশীল সমাজ হয়তো মনে করছে এখন প্রতিবাদ করলে, ন্যায় কথা বললে প্রতিকার তো দূরের কথা উল্টো হয়রানির শিকার হতে হবে।”
কুমিল্লার ঘটনার পর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কুমিল্লাসহ কয়েক জায়গায় ছুটে গেছেন। আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাদের পাশে থেকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন,"অন্যরা কেন যাননি, পাশে দাঁড়াননি তা তারাই বলতে পারবেন। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেছি। তবে এবার সিভিল সোসাইটি বলেন, রাজনৈতিক কর্মী বলেন তারা সবাই নির্লিপ্ত। যেন যা হয়েছে তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমরা কেউই দায়িত্ব এড়াতে পারি না। এভাবে চললে আরো খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।”
তার মতে,"প্রধান দায়িত্ব হল রাষ্ট্র ও সরকারের। তারা দায়িত্ব পালন করছে না। আর দেশে গণতন্ত্র না থাকায়, কথা বলার সুযোগ না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।”
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি তার অভিজ্ঞতা জনিয়ে বলেন,"এবার যা হয়েছে তা ১৯৭১ সালেও হয়নি। ভাতের থালাও লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন,"সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমরা আগে সিভিল সোসাইটির যে ভূমিকা দেখেছি এবার তা দেখতে পাচ্ছি না। আগে মতভেদ থাকলেও এই ধরনের ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতেন। কিন্তু এখন হচ্ছেন না। এর কারণ হতে পারে যে নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। পেশাজীবী সংগঠনগুলোও তাদের পেশার সুবিধার বাইরে এখন আর কথা বলছেন না।
তার মতে," সাম্প্রদায়িক হামলাসহ নাগরিকদের অধিকার এবং আরো নানা ইস্যুতে সিভিল সোসাইটি কথা না বললে গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন কঠিন হয়ে পড়ে।”
তিনি বলেন,"এখন একটি সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। কিছুদিন আগে দেখলাম নাসিরনগরের ঘটনায় চার্জশিটভুক্ত আসামিকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হলো। সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? সরকারের তো অনেক নেটওয়ার্ক আছে তারা কী করছে?”
আর রানা দাশগুপ্ত বলেন,"সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দলগুলো আপাতত বিবৃতিতে সীমবদ্ধ আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তারা আছে পারস্পরিক দোষারোপে, ব্লেম গেমে।”