ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার, ষড়যন্ত্রকারী দেশি-বিদেশি মহল বা দেশের ভেতরে লালিত সাম্প্রদায়িক শক্তি মোটা দাগে এই তিনপক্ষের কথা বলা যায়৷ মাঝের কুমিল্লায় শুরু হয়ে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে এই যে মন্দির মণ্ডপ বা হিন্দু জনপদে হামলা এটা কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এবারই প্রথম বা এখনই শেষ? প্রশ্ন রাখলাম, কারণ এরকম কথা শোনা যায় যে এরকম আর আগে দেখি নাই৷
দায়ের কথায় ফিরে আসি৷ যে তিনপক্ষের কথা উঠছে খেয়াল করলে দেখা যাবে তারা মোটের উপর একপক্ষই৷ এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সেই কবে নিজেদের রাজনৈতিক অভিধানে, খেলাফত-হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত, মদিনা সনদ বা কওমি জননী অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে৷ দলটির পরিচয়ের শিরে আর কপালে ধর্মের দাগ এখন দগদগ করছে৷ তাই সারাদেশ এমন জ্বালাও পোড়াও এর বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও মন্ত্রী এমপিরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন না, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো কেন্দ্রীয় কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে না, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় পাশের দেশকেও সাবধান থাকতে বলছেন৷ মানে কী? আরেকটা দেশে কী হচ্ছে, হয়েছে বা হবে তার উপর নির্ভর করবে আমার দেশের জনগণের নিরাপত্তা বা অধিকার? নাসিরনগর কাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত আসামি কী করে চেয়ারম্যান পদে নৌকা পাচ্ছেন তা দেখার সময় কি আপনার আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? পূজায় হামলা থেকে বালিশ-ক্যাসিনো কাণ্ড দেশের যে-কোনো নেতিবাচক ঘটনার দায় প্রতিপক্ষের উপর চাপানোই এখন নিয়ম৷ এক যুগ পরও শুনি সবকিছুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিএনপি জামাত বা অনুপ্রবেশকারী!
দেশি বা বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথায় আসি৷ এইসব ষড়যন্ত্র হতেই থাকে বলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এইসব কুকর্ম থেকে মানুষকে রক্ষা করা৷ কিন্তু রাষ্ট্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে বা শুধুই এক দলের কুক্ষিগত থাকলে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা যায় না৷ কেউ না কেউ কুমিল্লায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রেখে আসছে, তারপর বগলে-বই-থানার-ওসি এর সামনে একজন লাইভ ভিডিও করেছেন৷ অনেকে উদ্যোগী হয়ে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেন, কুমিল্লার আগুন ফেনী নোয়াখালী চট্টগ্রাম হয়ে রংপুরে গেছে৷ পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছেন এরা ভিনগাঁয়ের লোক কেউ তাদের চেনে না৷ মাননীয় পুলিশপ্রধান আপনার উচিত ছিল ভিন্নগ্রহের লোক হলেও এদের খুঁজে বের করা, নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা৷ আপনি কি পেরেছেন? অনেকেই বলেন, এটা পারতে হলে যে নৈতিক সাহস দরকার তা আপনার নেই৷ কারণ ক্রসফায়ার, গুম বা মামলা শক্ত করতে পকেটে ইয়াবা, আলমারিতে মদ গুঁজে দেওয়ার সহজ, কিন্তু কার্যকর সিস্টেম আবিষ্কারেই সময় যাচ্ছে আপনার, এইসব ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নিয়ে ভাবনার সময় কই?
দেশের ভেতরে দুধ ঘি মাখনে লালিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কি এখন খুব শক্তিশালী? যদি হয় এর কারণ কী? আমরা যারা নিজেদের সংখ্যাগুরু মনে করি, আরও মনে করি ৯০ বা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে আমরা যা চাই তাই হবে, তারা আসলে কারা? আমাদের সবাই কি এই কথিত অবমাননার জেরে এইসব হামলা জ্বালাও পোড়াও সমর্থন করি? আমরা কি চাই এই দেশ শুধু মুসলমানদের হোক? তাই যদি না হয়, তবে এই ঘটনায় বড় ইসলামি দলগুলোর বা চিন্তাবিদ-ওয়াজকারীদের কয়জনকে আমরা বলতে শুনেছি যে- খামোশ?
বরং আমরা প্রতিদিন শুনছি, হিন্দুদের জন্য নাকি মায়াকান্না করা হচ্ছে, মুসলমানেরা সারা পৃথিবীতে অধিকার বঞ্চিত, দেখে আসুন ভারতে কী হয়, ইত্যাদি৷ খেয়াল করলে দেখা যাবে ইনিয়ে বিনিয়ে দেশের লাইকলোভী বুদ্ধিজীবীরা এরকম কথা বলে আসছেন এবং একরকম ধরেই নেওয়া হচ্ছে এটাই বেশিরভাগ মানুষের মত৷ প্রশ্ন বা উত্তর জানার নির্বাচন দেশে নাই, আওয়ামী লীগও তাই এরকমই একটা জনমতকে মাননীয় মনে করে৷ মনে করে এটাই পাবলিক চায় এবং খায়৷ তাই যুগব্যাপী ক্ষমতাসীন দলটি স্রোতে ভেসে যায়, মনে করে মাথার উপর ধর্মের সনদ থাকলে হয়ত জননিন্দার ঢিল ফুল হয়ে ঝরবে৷ তর্ক উঠতে পারে আওয়ামী লীগ কোন কারণে পাবলিকের মতকে এত পাত্তা দেবে? তার কী ঠেকা? আমারও মনে হয় ঠেকা নেই৷ সম্ভবত শেখ হাসিনার দর্শনেই চলছে আওয়ামী লীগ, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বা সবার সমান অধিকারের কোনো জায়গা নেই, সংখ্যাগুরুদের চাওয়াই এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে৷ মাঝে মাঝে তরুণ তথ্য প্রতিমন্ত্রীর মত কম গুরুত্বের কেউ হুটহাট রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে বলবেন, হইহই সমালোচনার রোষে তিনিসহ আর সবাই সময়মত চুপও করে যাবেন৷