নজরবন্দি রামজন্মভূমি
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২তিনবার তিন জায়গায় তন্ন তন্ন করে তল্লাশির পর ঢোকা গেল সেই চত্বরে। তার আগেই ফোন, ক্যামেরা, পেন, ঘড়ি সব খুলে লকারে তালাবন্দি করে রাখতে হয়েছে। তারপর পা রাখা গেল, দেশের সবচেয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকা এলাকায়, যার প্রতিটি কোণে নজর রাখছে সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রতিটি কোণে সশস্ত্র পুলিশ। কাঁটাতারের বেড়ার পাশে বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। পুরো চত্বরে অসংখ্য সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দা গিজগিজ করছে।
হবে নাই বা কেন, চোখের সামনে বিশাল রেলিং ও বেড়ার ওপারেই তো সেই তিন দশমিক ৭৭ একরের জমি। যেখানে একসময় ছিল বাবরি মসজিদ। বিজেপি, ভিএইচপি সহ হিন্দু সংগঠনের দাবি, শ্রীরামের মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ গড়ে তুলেছিলেন বাবর। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সেই মসজিদ ধুলিসাৎ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এখন সেই জমি ও তার সঙ্গে আরও অনেকখানি এলাকা জুড়ে তৈরি হচ্ছে রামমন্দির কমপ্লেক্স।
ভেঙে ফেলা মসজিদের জায়গায় রামন্দিরের ভিত তৈরির কাজ শেষ। বিশাল একটা সাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। তার উপরেই তৈরি হবে মূল মন্দির। বহুতল বাড়ি বানাবার জন্য যে বিশাল ক্রেন লাগে, সেরকম একটি ক্রেন রাখা আছে। পাশে ছোট ক্রেনও আছে। প্রচুর মানুষ কাজ করছেন। এই রামমন্দির হবে বিশাল। ঢোকার পর প্রথমে একতলা, তারপর দোতলা, এরপর তিনতলা এভাবেই তলার সংখ্যা বাড়বে। এই মন্দিরের রেপ্লিকা রাখা রয়েছে রামলালার মূর্তি দর্শন করতে যাওয়ার পথে।
রামলালার দর্শন করতে
রামলালাকে দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন। এই করোনাকালেও ভিড় হচ্ছে প্রচণ্ড। লোহার খাঁচার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। বড়সড় চত্বরে লাল রঙের জুটের কার্পেট পাতা। সিংহাসন প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো, সেখানেই পিতলের রামলালার মূর্তি। তিরিশ সেকেন্ডের বেশি তার সামনে দাঁড়াতে দেন না নিরাপত্তা কর্মীরা। পূজারির হাত থেকে নকুলদানা, মিছরি প্রসাদ নিয়ে বাইরে যাওয়ার পথ ধরা।
রামলালার মূর্তি দেখে একটু এগোতেই একটা খাঁচায় বেশ কিছু মূর্তি ও পাথরের নকশা রাখা। জায়গাটি প্রহারার কাজে নিযুক্ত বেশ কয়েকজন আধা সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ান। তাদেরই একজন জানালেন, মন্দিরের ভিত তৈরির জন্য মাটি কাটতেই এই দেবদেবীর মূর্তি বেরিয়েছে।
মন্দির চত্বরের সামনের রাস্তা বিপুল চওড়া হচ্ছে। একেক দিকে ৪৫ ফুট। বহু দোকান ভাঙা পড়ছে। সরকার তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার সিংহভাগ যাচ্ছে বিভিন্ন মন্দিরের কাছে। কারণ, এই জমির মালিক তারাই।
রামমন্দিরে ঢোকার মুখে প্রদীপ শর্মার দোকান। কমিটি দাগিয়ে দিয়ে গেছে। পুরো দোকানটাই ভাঙা পড়ছে। ডিডাব্লিউকে প্রদীপ জানিয়েছেন, রামমন্দির বানানোর জন্য জমি নেয়া হচ্ছে বলে তার কষ্ট নেই। বিজেপির কট্টর সমর্থকের দাবি, তাদের জন্য বিকল্প জায়গা দিন যোগী।
পাথর কাটার কাজ
একটু দূরে করসেবকপুরমে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অফিসের পাশে জমিতে পাথর কাটার কাজ চলছে। সাদা পাথরের গায়ে চমৎকার ফুলপাতার নকশা। খিলান, কপাট সহ বিভিন্ন জায়গার জন্য আলাদা আলাদা নকশা। মূল কাজ হচ্ছে রাজস্থানে । করসেবকপুরমে কাজের জায়গার আয়তন তুলনায় ছোট। তবে সেখানেই রাখা আছে প্রচুর থাম ও মন্দিরের অন্য অংশ। ২০২৩ এর শেষ বা ২০২৪ সালের গোড়ায় খুলে দেয়া হবে মন্দিরের একাংশ।
এখানেই একপাশে ডাঁই করে রাখা জয় শ্রীরাম লেখা ইট। রামজন্মভূমি নিয়ে আন্দোলনের সময় যে ইট তৈরি হয়েছিল গ্রামে গ্রামে। সেই উন্মাদনা এখন অতীত। বর্তমান হলো, স্তূপীকৃত ইট ওভাবেই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। পাথরের তৈরি রামমন্দিরে ওই ইটের কোনো প্রয়োজন নেই।
তুলনাই চলে না
একটু আগেই ধন্নিপুর গিয়ে দেখে এসেছি বাবরির বিকল্প মসজিদ তৈরির কাজ একটুও এগোয়নি। শুধু একটা বেড়া দেয়া মাঠ আছে মাত্র।
আর মোদী-যোগীর শাসনে রামমন্দির তৈরি, রাস্তা চওড়া করা, সরযুর ঘাট সুন্দর করে বাঁধানো, সেখানে রোজ আরতি করা, সবমিলিয়ে একটা কর্মযজ্ঞ চলছে।লক্ষ্য, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে মন্দির শ্রীরামভক্তদের জন্য খুলে দেয়া। সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ করা, মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, অর্থাৎ, মোদীর পক্ষে সবই সম্ভব। এর মধ্যে একটা কথা অনুচ্চারিত আছে, তা হলো, মোদী অনেকদিন আগে থেকে ভোটকৌশল তৈরি করেন। তার সেই কৌশলের সামনে অধিকাংশ সময়ে বিরোধীদের বড় অসহায় দেখায়।
বিধানসভার ভোটে এই নির্মীয়মাণ মন্দির দেখিয়েই হিন্দু ভাবাবেগ তৈরি করেছে বিজেপি। লোকসভার সময় মন্দির তৈরি করে তা তোলা হতে পারে। কে বলে, ১৯৯২র পর রামমন্দির আর ভোটের ইস্যু নয়? বাবরি ধ্বংসের ৩০ বছর পরেও এখনো তার প্রভাব অপরিসীম, অন্তত এই গো-বলয়ের রাজনীতিতে।