শুধু খোলা মাঠ, বাবরির বিকল্প মসজিদ কই?
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২বিশাল একটা মাঠের মধ্যে নতুন রঙ করা একটা মাজার । তার আশে পাশে সামনে পিছনে শুধু মাঠ। একদিকে ছোট আমবাগান। এক সারি শালগাছ। গেট বলে কিছু নেই। দশফুটের একটা রাস্তা দিয়ে ধন্নিপুর গ্রামে পৌঁছে দুই পাশে দুইটি বোর্ড না থাকলে বুঝতেই পারতাম না, এই সেই ২০ বিঘে জমি, যার দিকে তাকিয়ে পুরো দেশ। কারণ, এখানেই গড়ে উঠবে বাবরির বিকল্প মসজিদ, সঙ্গে হাসপাতাল, কলেজ। মসজিদের পাশেই থাকবে দরগা। বোর্ডে ভবিষ্যতের মসজিদ কমপ্লেক্সের সুদৃশ্য ছবি লাগানো।
কিন্তু ওই ছবিটুকুই সার। গেটহীন চত্বরে ঢুকলেই দেখা যাবে, দুই পাশে গোটাকয়েক ছাগল বাঁধা আছে। ঘাসের মাঠ পেরিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে কিছুটা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয়েছে। আগে এই জমি ছিল কৃষি মন্ত্রকের কাছে। তারাই বীজতলা বানিয়ে চাষ করত।
চারদিকে তাকালে এই ধুধু মাঠ, বীজতলা, ছোট আমবাগান দেখতে দেখতে প্রশ্ন জাগে, মসজিদ কই? বাবরির বিকল্প মসজিদ? যে মসজিদ নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
আপত্তি সত্ত্বেও
অল ইন্ডিয়া বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতা ও আইনজীবী জাফরইয়াব জিলানি, এআইএমআইএম নেতা ও সাংসদ ওয়েইসি আগেই বলেছেন, তারা সরকারের দেয়া জমিতে মসজিদ করার পক্ষে নন। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এই জমিতে মসজিদ বানাতে রাজি হয়েছে। ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন তৈরি হয়েছে। তারাই মসজিদ, কলেজ, হাসপাতাল করবে। পুরো জমির বিভিন্ন পাশে গোটা চারেক বোর্ড লাগিয়েই আপাতত কাজ সেরেছে তারা। এই ধন্নিপুর ও তার আশপাশের গ্রাম হলো সুন্নিপ্রধান।
কেন, হাসপাতাল, কলেজ?
ধন্নিপুরে শুধু মসজিদ হবে না, সঙ্গে থাকবে একটা হাসপাতাল, কলেজ। ধন্নিপুরের মানুষ হাসপাতাল, কলেজের দাবি নিয়েই বেশি সোচ্চার। ইসলাম খানের বাড়ি ঠিক প্রস্তাবিত মসজিদের উল্টোদিকে। তিনি বলছিলেন, মসজিদ আমাদের গ্রামে আছে। তাই আরেকটা ছোট করে মসজিদ হতে পারে। কিন্তু এখানে বড় করে হাসপাতাল ও কলেজ দরকার। ইসলাম জানিয়েছেন, কারো গুরুতর অসুখ করলে লখনউ নিয়ে যেতে হয়। আর গ্রামে মেয়েদের জন্য ক্লাস এইট পর্যন্ত স্কুল আছে। আর একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। তাই তাদের দরকার কলেজ ও হাসপাতাল।
ইসলাম যখন এই কথা বলছেন, তখন সাইকেল থামিয়ে যাদবজি তাকে সমর্থন করে বললেন,''আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমানে কোনো ঝগড়া নেই। আমরাও কলেজ-হাসপাতাল চাই''
কিন্তু কবে?
জমি পড়ে আছে, বোর্ড লাগানো হয়েছে, কিন্তু তারপর কিছু হয়নি। ২২ কিলোমিটার দূরে অযোধ্যায় রামমন্দিরের কাজ যখন পুরোদমে চলছে, তখন এই মাঠ, আমবাগান, পড়ে আছে চুপচাপ। প্রদীপের নীচের অন্ধকারের মতো বা বলা যায় দুয়োরানি হয়ে। ধন্নিপুরের নিস্তরঙ্গ জীবনে মসজিদ কেন্দ্র করে কোনো তাপউত্তাপ নেই। আছে শুধু একটাই প্রশ্ন, কবে কাজ শুরু ও শেষ হবে?
আক্ষেপ করে ইসলাম বলছিলেন, ''মনে হয় না, জীবদ্দশায় মসজিদ দেখে যেতে পারব।''
মাজারের ভিতর
মাজারে এসে প্রার্থনা করছিলেন পাশের গ্রামের শ্রীপ্রসাদ। মাজারের বাইরে সাইকেল রেখে প্রথমে ঝাঁট দিয়ে সব সাফ করলেন। তারপর প্রার্থনা। শ্রীপ্রসাদ, সাঁই সম্প্রদায়ের মানুষ, হিন্দু। তাও এখানে নিয়মিত আসেন প্রার্থনা করতে। এত বিতর্ক, আদালতের নির্দেশ, উত্তেজনা, আলোচনার পরেও বাবরির বিকল্প মসজিদের জায়গায় শুধু খোলা মাঠ দেখে যতটা অবাক লেগেছিল, শ্রীপ্রসাদ কে দেখে তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছি। অযোধ্যা নিয়ে বা বলা ভালো, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও রামমন্দির তৈরির এই আবহে শ্রীপ্রসাদ মাজারে যাচ্ছেন, তা সাফ করছেন এবং প্রার্থনা করছেন। তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সব শেষ হয়ে যায়নি। শুধু বিভাজনকারী রাজনীতি শেষ কথা বলবে না। বরং শেষ কথা বলবেন শ্রদ্ধার, বিশ্বাসের, সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলা শ্রীপ্রসাদরাই।