ধর্ষিতার আগুনে শুরু নতুন বছর!
৬ জানুয়ারি ২০১৪ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেলে পুলিশ-প্রশাসনের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রিয় যুক্তি, পুলিশের উপর মানুষের আস্থা বাড়ছে, তাই অভিযোগ নথিভুক্ত করার হারও বাড়ছে৷ পুলিশে অভিযোগ করলে কী হয়, সেটাও এবার নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল কলকাতা শহরতলীর মধ্যমগ্রামের ১৬ বছরের ওই তরুণী, যাকে দ্বিতীয়বার ধর্ষিতা হতে হয়েছিল প্রথমবারের ধর্ষণ চুপচাপ মেনে নিতে চায়নি বলে৷ প্রথমবার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল৷ সেই নিগ্রহের অভিযোগ জানিয়ে বাবার সঙ্গে থানা থেকে ফেরার পথে মেয়েটিকে অপহরণ করে ফের ধর্ষণ করা হলো৷
এর পর শুরু হয়েছিল অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে ওই মেয়েটি ও তাঁর পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল৷ ভয় দেখানো হচ্ছিল৷ পাশাপাশি ছিল পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা যে, ধর্ষিতা কেন এর পরেও লজ্জায় মুখ ঢেকে ঘরবন্দি থাকছে না! কেন সে থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারির মধ্যে গিয়ে লোকলজ্জা আরও বাড়াচ্ছে! বিহার থেকে আসা দরিদ্র পরিবারটি, যেখানে গৃহকর্তা ট্যাক্সি চালিয়ে সংসারের এবং ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগান, তারা ওই লাগাতার হুমকি আর সামাজিক হেনস্থার হাত এড়াতে মধ্যমগ্রাম ছেড়ে কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে একটি ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন৷ কিন্তু সেখানেও মেয়েটিকে কেউ কেউ চিনে ফেলে এবং পরিবারটিকে ফের পাড়াছাড়া করার চেষ্টা শুরু হয়৷
অবশেষে ৩১শে ডিসেম্বর সকালে রহস্যময়ভাবে মেয়েটি আগুনে পুড়ে গুরুতর আহত হয় এবং হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে দেওয়া জবানবন্দিতে সে পুলিশকে জানায়, তাঁর ধর্ষণের অন্যতম মূল অভিযুক্ত এবং ছেলেটির মাসতুতো ভাই, যে নাকি তাঁদের এখনকার বাড়িওয়ালির ছেলে, তারা দুজনে ওঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷ এর পর শেষ খবর, পুলিশ নাকি খুবই ধন্দে আছে মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দির সত্যতা নিয়ে৷ কারণ, বাড়িওয়ালি মহিলা দাবি করেছেন যে তাঁর ছেলে এবং বোনপো মেয়েটির গায়ে আগুন ধরায়নি বরং মেয়েটি নিজেই আত্মঘাতী হয়েছে! মেয়েটির মা এই বক্তব্যকে মিথ্যা বলে পাল্টা দাবি করেছেন৷
পুলিশের সংশয়ের অবশ্য এখানেই শেষ নয়৷ অভিযোগ, প্রথমবারের ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত করলেও মেয়েটির দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেছিল মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ৷ বরং পরোক্ষে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে মেয়েটি নাকি নিজেই তাঁর ধর্ষণকারীদের সঙ্গে গিয়েছিল৷ কিন্তু যেহেতু মেয়েটিকে তাঁর বাবার সামনে থেকে অপহরণ করা হয়েছিল সেবার, অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ এবং প্রথমবারের ধর্ষণের অভিযোগই দায়ের করা হয়, দ্বিতীয়বারেরটি নয়৷ আইনজীবীরা অবশ্য আরও একাধিক অভিযোগ তুলছেন পুলিশের বিরুদ্ধে৷ তার মধ্যে সবথেকে বড় অভিযোগ, কেন একজন ধর্ষিতার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারল না পুলিশ! কী করে থানা থেকে ফেরার পথে ফের আক্রান্ত হতে হলো মেয়েটিকে!
যদিও দ্বিতীয়বারের ধর্ষণের পর মেয়েটির বাড়ির বাইরে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা বসানো হয়, কিন্তু তার পরেও হুমকি এবং সন্ত্রাস কোন পর্যায়ে পৌঁছলে একটি পরিবার পাড়াছাড়া হতে বাধ্য হয়, সেই প্রশ্ন উঠছে৷ একমাত্র তৎপর হয়েছিল পুলিশ, যখন বামপন্থী সিটু ট্যাক্সিচালক ইউনিয়নের সদস্যরা মেয়েটির মৃতদেহ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করতে চাইলে প্রশাসনের নির্দেশে প্রায় জোর করে, মেয়েটির পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মৃতদেহটির অন্ত্যেষ্টি করাতে চেয়েছিল পুলিশ৷ কিন্তু সেখানেও উত্তর ২৪ পরগণা এবং কলকাতা পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দড়ি টানাটানির পর্যায়ে চলে যায়৷
এই ধর্ষণ এবং অকালমৃত্যুর প্রতিবাদে কলকাতায় ফের পথে নেমেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা৷ মোমবাতি মিছিল, ধিক্কার জানানো, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি, সবই হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কি চেতনা ফিরল? অন্তত আইন-রক্ষকদের, যারা ধর্ষণের প্রতিরোধ, প্রতিকার বা প্রতিবিধানের বদলে নিজেদের দায় এড়াতে বাধ্য থাকে? আদৌ না৷ খাস শহর কলকাতায় ওই ৩১শে ডিসেম্বরের রাতেই এক মহিলাকে শায়েস্তা করতে তাঁকে নিয়ে দৌড় লাগিয়েছিল এক বেপরোয়া ট্যাক্সিচালক৷ মা এবং ভাইকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁয় খেতে আসা ওই মহিলার অপরাধ ছিল, কোনও ট্যাক্সি যেতে চাইছিল না বলে তিনি জোর করে একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বসেছিলেন৷ দুই বাইক আরোহীর তৎপরতায় তিনি উদ্ধার পান, ওই ট্যাক্সিচালককেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ কিন্তু মহিলার অভিযোগ, এর পর পুলিশই নাকি তাকে চাপ দিচ্ছিল কোনও অভিযোগ নথিভুক্ত না করতে৷ কারণ, তাতে নাকি কোর্ট-কাছারিতে দৌড়োদৌড়ি করে জেরবার হতে হয়!