ধর্ষণের অভিযোগ বেড়েছে
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়৷ শরীরের রক্তাক্ত ক্ষতও আর তাজা থাকে না, কিন্তু মানুষের বিবেকেও কি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়? দিল্লির রাস্তায় এক যুবতীর উপর চরম যৌন অত্যাচার এবং পরিণতিতে তাঁর করুণ মৃত্যু সারা ভারতের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ ভয়ঙ্কর ওই ধর্ষণের ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে হয়ে উঠেছিল সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম৷ এই কলঙ্কমোচনের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল প্রশাসন৷ নেওয়া হয়েছিল বেশ কিছু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, যাতে রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তা অন্তত নিশ্চিত করা যায়৷ একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ধর্ষণ প্রবণতার বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেতনতা প্রসারে সচেষ্ট হয়েছিল৷ ধর্ষণ-মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও উদ্যোগী হল বিচারবিভাগ৷ কিন্তু আদৌ কি কোনও সুরাহা হল তাতে?
দিল্লির পরিস্থিতির দিকেই প্রথমে নজর দেওয়া যাক৷ ২০১২ সালে, অর্থাৎ গণধর্ষণের ওই বছরে দিল্লি পুলিশের কাছে ৬৬১টি ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছিল৷ পাশাপাশি শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের হয়েছিল ৬২৫টি এবং অশালীন আচরণের অভিযোগ ১৬৫টি৷ চলতি বছরে, অর্থাৎ ২০১৩ সালে নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত সেখানে ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে ১,৪৯৩টি৷ গত বছরের তুলায় দ্বিগুণেরও বেশি৷ শ্লীলতাহানি সংক্রান্ত অভিযোগ বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ, ৩,২৩৭টি ও অশালীন আচরণের অভিযোগও প্রায় পাঁচ গুণ, ৮৫২টি৷ এখানে উল্লেখ করা দরকার যে নথিভুক্ত অভিযোগের বাইরেও থেকে যায় অসংখ্য যৌন অপরাধের ঘটনা, যেখানে নির্যাতিতারা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে আসেনই না৷
যে কারণে দিল্লি পুলিশ কিন্তু অভিযোগের সংখ্যা এই হারে বেড়ে যাওয়াটাকেই একটা বড় সাফল্য বলে মনে করছে৷ একই কথা বলছে যৌন হেনস্থার প্রতিবিধানে সচেষ্ট এনজিও এবং স্বাধিকার সুরক্ষা সংগঠনগুলিও৷ তাদের বক্তব্য, অভিযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে মানে, ক্রমশ আরও বেশি সংখ্যক মহিলা তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন এবং লোকলজ্জা ও অন্যান্য সংস্কার অগ্রাহ্য করে আইনের সাহায্য চাইছেন৷
এটা একেবারেই খাঁটি কথা৷ কিন্তু এই সত্যের আড়ালে আরও এক ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে যে, এক বছর আগের ওই গণধর্ষণ এবং তার প্রতিবাদে নাগরিক প্রতিবাদ, সমবেত প্রতিরোধের প্রচেষ্টা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করেনি ধর্ষণকারীদের মনে৷ ধর্ষণকামী মানসিকতা এতটুকু বদলায়নি, বাড়েনি মহিলাদের নিরাপত্তা৷ এটা শুধু দিল্লিতে না, ভারতের সমস্ত বড় শহরের পরিসংখ্যান নিলে সম্ভবত একই ছবি দেখা যাবে৷ কলকাতা বা মুম্বইয়ের মতো তথাকথিত আধুনিকমনস্ক শহরেও বাসে-ট্রামে-মেট্রোয়-লোকাল ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করেন যেসব মেয়ে, তাঁদের কাছে জানতে চাইলেই সত্যিটা পরিষ্কার হবে, মন্তব্য করলেন কলকাতার এক সমাজকর্মী৷
এর পাশাপাশি আছে আইনের দুর্বলতা৷ দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনায় সবথেকে বিকৃতকাম ও অপরাধপ্রবণ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল যে কিশোর, আইনের চোখে সে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তার বিচার হয়েছে শিশু ও কিশোর অপরাধীদের জন্য নির্দিষ্ট জুভেনাইল আদালতে৷ যদিও শুধু মেয়েটিকে ধর্ষণ করাই নয়, ধর্ষিতা মেয়েটির যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে তাঁর শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে ছিঁড়ে বার করে আনার মতো বিকৃত পাশবিকতার দায়ে সে অভিযুক্ত হয়েছিল, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জন্য তার মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে৷ এই কারাবাসের সময় যে অবাধ্য, বেপরোয়া মনোভাব ছেলেটি দেখাচ্ছে, তাতে সংশোধনাগারের কর্তাব্যক্তিরা আতঙ্কিত যে আর দুবছর পর ছাড়া পেয়ে কী ভয়ঙ্কর দানব হয়ে উঠবে ছেলেটি!
বস্তুত এই ছেলেটির আচরণ দেখার পর থেকেই ভারতীয় বিচারবিভাগ নতুন করে ভাবতে বসেছে যে কিশোর অপরাধীদের মানসিক মূল্যায়নের ভার সংশ্লিষ্ট বিচারকদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই উচিত কাজ হবে কিনা৷ যেখানে খাতায়-কলমে নথিবদ্ধ বয়স নয়, বরং অপরাধের চরিত্র, গুরুত্ব এবং অভিযুক্তের অপরাধপ্রবণতাই একমাত্র বিচার্য বিষয় হবে, যাতে কম বয়স হওয়ার অজুহাতে অপরাধী লঘু শাস্তি পেয়ে পার না পেতে পারে৷ আরও একটি ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ৷ ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে যতই মোমবাতি মিছিল আর টিভি চ্যানেলের গুরুগম্ভীর বিতর্কসভা হোক, একজন মানুষের এই নিগ্রহ যে আসলে মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ, মনুষ্যত্বের হানি, এটা এখনও অনেককে বোঝানো যাচ্ছে না৷