ধর্মীয় সম্প্রীতি বাড়াতে প্রকল্প হয়েছে, তবে পরিস্থিতি বদলায়নি
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এসব প্রকল্প দিয়ে কাজ হবে না৷ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে৷ আর সাম্প্রদায়িক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো যারা করছে, তাদের কাছে ধর্মের বাণীর কথা বলে লাভ নেই৷ তারা স্বার্থান্বেষী মহল৷ তারা লাভের জন্য এই কাজ করে৷ ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না৷’’
জনগণের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বাড়াতে গত বছরের জুলাইয়ে ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়৷ সেই প্রকল্পের আওতায় ‘বাংলা ঢোল লিমিটেড’ ও ‘রিভ সিস্টেম’ নামে একটি আইসিটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও করে৷ মূলত প্রচার প্রচারণামূলক এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৫ কোটি টাকা৷
মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পে পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন উপ-সচিব আবদুল্লা-আল-শাহীন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যে অনেকগুলো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি৷ আমরা লিফলেট বিতরণ করেছি, দুর্গাপূজার সময় পোস্টার ছাপিয়ে সারাদেশে সেগুলো লাগানোর ব্যবস্থা করেছি, টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণামূলক অনেকগুলো কাজ করেছি৷ টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিভিন্ন নাটকের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আমরা টক শো করেছি, ডকুমেন্টারিসহ প্রতিটি জেলা শহরে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছি৷ জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মসজিদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এসব সভায় ডাকা হয়েছে৷’’
এই ধরনের আলোচনায় কখনো কেউ ডেকেছিল কিনা জানতে চাইলে যশোর সদরের সাড়াপোল মসজিদের ইমাম আকরাম হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইসলামী ফাউন্ডেশন তো মাঝে মধ্যে আমাদের নানা অনুষ্ঠানে ডাকে৷ সব জায়গাতেই ধর্মীয় সম্প্রীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে আলোচনা হয়৷ ফলে এই ধরনের কোনো প্রকল্পের অনুষ্ঠানে ডেকেছিল কিনা বলতে পারবো না৷’’
তবে যশোর শহরের পালবাড়ির বায়তুন নূর জামে মসজিদের ইমাম আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার যদ্দুর মনে পড়ছে, এই ধরনের প্রকল্পের বিষয়ে আমাদের বলা হয়েছিল৷ একটা আলোচনাসভা হয়েছিল, সেখানে আমাকেও ডেকেছিল৷ সেটা কয়েকমাস আগের ঘটনা৷’’ এসব প্রকল্পে টাকা খরচ করে সত্যিকার অর্থে কোনো ফল পাওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘তা বলতে পারবো না৷ তবে এই ধরনের সভাগুলোতে যা বলে, তা প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই বলে৷ আমরাও খুতবায় সেগুলো বলি৷ এগুলো তো নতুন কিছু না৷ তারা না ডাকলেও আমরা বলতাম৷’’
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গত বছরের জুলাইয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় মিডিয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা ঢোল লিমিটেড’ ও আইসিটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘রিভ সিস্টেম লিডিটেড’-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেন, ‘‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে রক্ষা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর৷ যে ধরনের ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে, এগুলোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স৷ এসব ঘটনা ঘটিয়ে কেউ পার পাবে না৷ কোনো অবস্থাতেই কোথাও যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্যই এখন সম্প্রীতি বাড়াতে ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্মসূচিগুলো হাতে নিয়েছে৷’’
মিডিয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রমোশনাল কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিচ্ছে আইসিটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘রিভ সিস্টেম লিমিটেড’৷ এটি ‘অ্যাডি সফট লিমিটেড’ ও ‘প্রাচুর্য ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’ নামে দু'টি আইসিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করছে৷ কী ধরনের কাজ করছে তারা? এ সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে রিভ সিস্টেমের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিত সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই প্রকল্পের আওতায় একটি ডায়নামিক ওয়েব পোর্টাল ও ড্যাশবোর্ড, ১০টি মোবাইল অ্যাপ, একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ভিত্তিক বট সিস্টেম ডেভেলপ করা হয়েছে৷ কয়েকটি অ্যাপ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে৷ কিছু টিভিসিও তৈরি করা হয়েছে৷ সেগুলো দ্রুতই টেলিভিশনে প্রচারিত হবে৷ একইসঙ্গে ডিজিটাল প্রচারণা, একটি পিআর সিস্টেম প্রস্তুতের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় বাণীর প্রচার ও ক্ষুদে বার্তাসহ ভয়েস মেসেজ, ই-মেইল বার্তা পাঠানো হয়েছে৷ ইতিমধ্যে ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে৷ বাকি কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে৷’’
‘বাংলা ঢোল লিমিটেড’ কী ধরনের কাজ করেছে জান চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ট্যাডিশনাল এবং ডিজিটাল সব ধরনের কমিউনিকেশনের তথ্যই তৈরি করে প্রচার করেছি৷ আমরা ট্যাডিশনাল কাজের মধ্যে পোস্টার বানিয়ে সেগুলো দেয়ালে লাগানোর ব্যবস্থা করেছি৷ টিভি নাটক করেছি, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি, ওয়েব সিরিজ করেছি৷ আর ডিজিটাল কাজের মধ্যে ফেসবুক পোস্ট করা হয় নিয়মিত৷ এছাড়া মিউজিক ভিডিও করেছি, ডকুমেন্টারি করেছি৷ এই কাজগুলো জেলা পর্যায়েও হয়েছে৷ গত পূজার সময় পোস্টার ছাপিয়ে সবগুলো মন্ডপ ও মন্দিরে লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এই কাজগুলো ইসলামী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে৷ সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের বিষয়টি এসব পোস্টারে তুলে ধরা হয়েছে৷ কিছু অ্যানিমেশন ভিডিও তৈরি করা হয়েছে৷ আমরা যুবকদের মধ্যে এই প্রচারণায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি৷ ওয়েব সিরিজ আর টিভি নাটকগুলোর খুব শিগগিরই প্রচার শুরু হবে৷’’
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পের আওতায় পোস্টার বানিয়ে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইসলামি ফাউন্ডেশন টাঙ্গাইলের উপ-পরিচালাক মোহাম্মদ আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্গাপূজার সময় আমাদের কাছে এই পোস্টারগুলো পাঠানো হয়েছিল৷ আমরা লোক দিয়ে সেগুলো লাগানোর ব্যবস্থা করেছি৷ যে আলোচনাসভা হয়েছে, সেখানেও আমাদের ডাকা হয়েছিল৷ এর বাইরেও আমরা ইসলামি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নানা ধরনের আলোচনার আয়োজন করি৷’’