দুর্গাপূজায় হামলা, অভিযুক্তরা মুক্ত
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ভাঙচুর করা হয় শতাধিক মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িঘর। ওই সময় দায়ের করা মামলার আসামীরা এখন জামিনে মুক্ত। ফলে এবার আনন্দের সঙ্গে আছে শঙ্কাও।
গতবারের হামলার ঘটনায় শুধু নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুরেই ৫৬টি মামলা হয়েছিল। এর অর্ধেক মামলায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তারও হয়েছিল চার শতাধিক আসামি। কিন্তু অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়ে গেছেন। তবে কুমিল্লার মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার মুল হোতা ইকবাল এখনও কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
ওই সময় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ২৬টি মামলার তদন্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা ২৬টি মামলার মধ্যে ১৪টি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছি। একটি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছি। আর ১১টি মামলা বর্তমানে তদন্তাধীন। প্রতিটি মামলা অত্যন্ত যত্ন করে তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে আমরা চার্জশিট দিয়েছি।”
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাছে যে ২৬টি মামলা ছিল এর মধ্যে কুমিল্লার ৪টি, নোয়াখালির ১১টি, চাঁদুপরের ৩টি, মৌলভীবাজারের ২টি এবং চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটের একটি করে মামলা। এছাড়া কক্সবাজার ও বান্দরবানের ৪টি মামলা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের একটি, কুমিল্লার একটি, বান্দরবারের একটি, নোয়াখালীর ৯টি, চাঁদপুরের একটি ও বাগেরহাটের একটি মামলার চার্জশিট দিয়েছে পিবিআই। বান্দরবানের একটি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লার তিনটি, কক্সবাজারের দুইটি, নোয়াখালীর দুইটি, চাঁদপুরের দুইটি ও মৌলভীবাজারের দুইটটি মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।
এই মামলাগুলোতে পিবিআই ১৭২ জনকে গ্রেফতার করেছিল। এর মধ্যে ১২৮ জন জামিনে মুক্তি পেয়ে গেছেন। ৩২ জন আসামী আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তাদের জামিনে মুক্তি দেন। ওই সময় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় কয়েক জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নয়জন মারা যায়।
বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এবার উচ্ছ্বাস আছে। আমাদেরও প্রস্তুতিও আছে। সরকারও প্রস্তুতি নিয়েছে। আমরা যেহেতু এই সমাজের মানুষ, ফলে উদ্বেগ, শঙ্কা আর উচ্ছ্বাস সবই থাকবে। এর মধ্যেই আমাদের প্রস্তুতি চলছে। আমরা আশাবাদী সবাইকে নিয়ে এবার সুন্দরভাবে পূজা উৎযাপন করতে পারব।”
কুমিল্লার মূল হোতা এখনও জেলে
গত বছর অষ্টমীপূজার দিন ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়া যায়। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত মানুষ মণ্ডপ ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রধান অভিযুক্ত ইকবালকে ২১ অক্টোবর কক্সবাজার থেকে আটক করে পুলিশ। ইকবাল এখন কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। এ ঘটনায় কুমিল্লায় মোট ১৩টি মামলা হয়েছিল। গ্রেপ্তার হয়েছিল ১০৭ জন। এদের অধিকাংশই এখন জামিনে মুক্ত।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "১৩টি মামলার মধ্যে দুইটি মামলার তদন্ত করেছে জেলা পুলিশ। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে পিবিআই চারটি ও সিআইডি বাকি মামলাগুলোর তদন্ত করেছে। জেলা পুলিশ যে দু'টি মামলার তদন্ত করছে তা একেবারেই শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। তবে যার কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছিল সেই ইকবাল এখনও কারাগারে বন্দী আছে।”
অন্য মামলাগুলোর অবস্থা কী?
গত বছর নোয়াখালীতে পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় ৩২টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০টি মামলার তদন্ত করেছে জেলা পুলিশ, ১১টি পিবিআই ও ১১টি সিআইডি। নোয়াখালির পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জেলা পুলিশ যে ১০টি মামলার তদন্ত করেছিল তার নয়টির চার্জশিট ইতিমধ্যে আদালতে দাখিল করা হয়েছে। অপর মামলাটিরও তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। যে কোন সময় চার্জশিট দেওয়া হবে।”
পিবিআই এখানকার যে ১১টি মামলার তদন্ত করেছে তার নয়টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। বাকী দুইটি মামলা তদন্তাধীন। এই ৩২টি মামলায় এজাহারে থাকা আসামির সংখ্যা ৪১২ জন। আর সন্দিগ্ধের সংখ্যা আট থেকে নয় হাজার। পুলিশ মোট ২৩৫ জন আসামি গ্রেফতার করেছিল। তাদের অধিকাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে গেছেন।
এদিকে একই ঘটনায় চাঁদপুরে ১১টি মামলা হয়েছিল। এর পাঁচটি মামলার তদন্ত করেছিল জেলা পুলিশ। পিবিআই তিনটি আর সিআইডি তিনটি মামলার তদন্ত করেছে। পিবিআই একটি মামলার চার্জশিট দিয়েছে। অন্য দু'টি মামলা তদন্তাধীন। চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জেলা পুলিশ পাঁচটি মামলারই চার্জশিট দিয়েছে।”
গত বছরের ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলার পর আট ঘণ্টায় ৭৬ জনকে আটক করেছিল পুলিশ। গ্রেপ্তার আসামিরা সবাই এখন জামিনে মুক্ত। চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আসামিরা জামিনে মুক্ত থাকায় আমরা কিছুটা শঙ্কার মধ্যে আছি। তবে সরকার এবার যে ব্যবস্থা নিয়ে তাতে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। আমরা প্রত্যাশা রাখি বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সার্বিক সহযোগিতা এবারের উৎসব শান্তিপূর্ণ হবে।”
এবারের পূজায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা পুলিশ কমিশনারের
আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, পূজাকে কেন্দ্র করে দুই ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। একটি হলো- জঙ্গি হামলার, আরেকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করা। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশসহ সবাই কাজ করছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন শেষে তিনি এসব কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে, ভুয়া একাউন্ট খুলে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার একটি প্রবণতা সবসময়ই থাকে। গত বছর কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন শরিফ রাখা নিয়ে যে ঘটনা ঘটলো, সে ধরনের অপচেষ্টা এ বছরও থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, মাস খানেক আগে থেকে আমরা এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছি। এরই মধ্যে আমরা জানতে পেরেছি, প্রায় ৫০ জন ছেলে তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছেন। তারা কোথায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তা নিয়ে আমরা কাজ করছি ও অনেক দূর এগিয়েছি। আশা করি, ফিল্ড অপারেশনে আসার আগেই তাদের ধরতে পারবো।
পুলিশ কমিশনার বলেন, কোনো মণ্ডপে প্রতিমা থাকা অবস্থায় ২৪ ঘণ্টা সেখানে মানুষ থাকতে হবে। কেউ না কেউ পাহারায় থাকবেন। প্রতিমা বানানোর আগে থেকেই আমরা আয়োজকদের এসব নির্দেশনা দিয়ে আসছি।
রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ১০ বছরেও বিচার শুরু হয়নি
কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ১০ বছর পূর্ণ হল বৃহস্পতিবার। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে গুজবের সূত্র ধরে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লীর ২৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। পরেরদিন একই ঘটনার জের ধরে উখিয়া-টেকনাফে আরও সাতটি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যে ফাটল দেখা দেয় পুরো দেশে। পুড়ে যাওয়া ঐতিহ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দ্রুত সময়ে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার তৈরি করে দেওয়া হয়। কিন্তু গত ১০ বছরেও সাক্ষীর অভাবে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। ফলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্য শীল প্রিয় মহাথের ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ঘটনার ১০ বছরে আমরা বাহ্যিক ক্ষত কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু এখনো বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় শঙ্কা থেকে যায়। কখন আবার ধর্মান্ধ এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের আক্রমণের শিকার হতে হয়। সরকার সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অনেক সাক্ষী নিরাপত্তার কারণে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকার চাইলে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে অপরাধী শনাক্ত করে বিচার শেষ করতে পারত। দেশের যে অবস্থা তাতে আমরা এখনও শঙ্কার মধ্যেই আছি।”
৯ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর সাড়ে ৩ হাজার হামলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত বছর সারাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে ১০২টি। আর গত ৯ বছরে হামলা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার। কোভিড কালেও ২০২০ সালে হিন্দুদের ১২টি বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়, তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৬৭টি মন্দির-উপাসনালয়ে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় আহত হন ৭১ জন।
আসক বলেছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গত নয় বছরে সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ৩ হাজার ৬৫৮টি হামলার ঘটনা ঘটে। বছরগুলোতে শুধু মন্দির ও উপাসনালয়ে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এক হাজার ৬৭৮টি। হামলার শিকার প্রায় ৯৯ শতাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন) আলী আহমেদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সবগুলো মামলাই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে পুলিশ। গত বছর যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তার অধিকাংশ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত শেষ করতে সময় লাগে। আবার কোন মামলা দ্রুতই সনাক্ত করা যায়। এবার পূজার আয়োজনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।”