দাঙ্গা হলে কাদের লাভ?
৭ জুলাই ২০১৭বসিরহাট এবং সংলগ্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং তার জেরে যে রাজনৈতিক চাপানউতোর, সংবাদমাধ্যমের সুবাদে সে খবর সবারই জানা৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ, যে তিলকে তাল করা হচ্ছে৷ গুজব যাতে আর না ছড়ায়, সেজন্য বসিরহাট এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে ভুল খবর, বিদ্বেষমূলক গুজব না ছড়াতে৷ টুইটার, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও আবেদন রাখা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য যাতে নষ্ট না হয়৷
আবার এর ঠিক উল্টোটাও হচ্ছে৷ ওই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই অজস্র জাল ছবি এবং ভুয়ো খবর দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে, যে পশ্চিমবঙ্গের ওই সীমান্ত এলাকা দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য জামাতি গুন্ডা নাকি সীমান্ত পেরিয়ে এ রাজ্যে ঢুকে এসেছে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় মুসলিমরা দাঙ্গা বাধিয়েছে৷ এই খবরে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে অন্যত্র৷ সংবাদমাধ্যম অভিযুক্ত হচ্ছে খবর চেপে যাওয়ার জন্য৷ সরকার অভিযুক্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু স্বার্থকে বেশি পাত্তা দেওয়ার জন্য এবং স্বাধীন, ধর্ম নিরপেক্ষ মতামতকে চিহ্নিত করা হচ্ছে দেশদ্রোহী হিসেবে৷
এই পরিস্থিতিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং এক ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মী সৌম্য মন্ডল ও তাঁর আরেক বন্ধু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই গিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে, যেখানে নাকি দাঙ্গা বেধেছে৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সৌম্য জানিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা৷ যেমন, যে ঘটনা থেকে অশান্তির সূত্রপাত, তা হলো, একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র মক্কা শরিফ এবং হজরত মহম্মদের একটি আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিল৷ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই হিন্দু ছেলেটির যে মুসলিম বন্ধুরা আছে, তারা দল বেঁধে এসে ছেলেটির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হল্লা করে, ছেলেটির সঙ্গে তাদের ঝগড়াও হয়৷
ঠিক যেমনটা হয় বন্ধুদের মধ্যে৷ বন্ধু যদি কোনো ভুল কাজ করে, তা হলে বাকি বন্ধুরা দল বেঁধে যেমন তাকে চেপে ধরে, এই ঘটনাটি ছিল ততটাই স্বাভাবিক৷ এখানে সৌম্য মন্ডলের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি পর্যবেক্ষণ হলো, এই অঞ্চলে আলাদাভাবে হিন্দু এলাকা, মুসলিম এলাকা বলে কিছু নেই৷ বরং এক পাড়াতে, পাশাপাশি বাড়িতে, হিন্দু-মুসলমান সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই থাকেন৷ কিন্তু হঠাৎই এখানে একদল মুসলিম ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে এসে উপস্থিত হয় এবং অভিযুক্ত ছেলেটির বাড়িতে ইট মারে, ভাঙচুর করে এবং শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়৷
সৌম্য মন্ডল পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছেন, যে এই ঘটনার জন্য স্থানীয় মুসলিমরা খুবই লজ্জিত যে তাঁদের পাড়ায় এমন একটা হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে গেল৷ এবং অভিযুক্ত ছেলেটির পরিবারকে এখন মুসলমানেরাই আগলে রেখেছেন, বাড়ির আগুন নেভাতেও তাঁরাই এগিয়ে এসেছিলেন সবার আগে এবং দমকল আর পুলিশে তাঁরাই খবর দিয়েছেন — যা পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে৷ এবং এখনও এলাকার সম্প্রীতি, শান্তি অক্ষত রাখতে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে৷ ওখানকার সব মন্দির, মসজিদ অক্ষত৷ কিন্তু তার পরেও যেটা সমস্যা হয়েছে, গুজবের আগুন ছড়াচ্ছে৷ ফলে বিচ্ছিন্ন হাঙ্গামা ঘটছে, যার জন্য অভিযোগের আঙুল কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের দিকেই উঠছে৷ আর সেটা হলো বিজেপি এবং যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, সম্ভবত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন ছাড়াই কিছু অতি উৎসাহী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে৷ এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপিরও সম্ভবত প্ররোচনা আছে, যাদের কাছ থেকে শুনে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নেমে পড়েছিলেন৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং রাজ্যপালকে নিরস্ত করেছেন৷ একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের টেলিফোন কথোপকথনের যে রেকর্ড আছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্র সরকার চাইছে না এই গণ্ডগোল আর ছড়িয়ে পড়ুক৷ ফলে সুর নরম করেছেন রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়ে রাজ্য প্রশাসন দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছে৷
কিন্তু তার পরেও ছুরির ঘায়ে জখম এক আরএসএস কর্মীর মৃত্যু নিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে মরিয়া রাজ্য বিজেপি৷ ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমেও কমছে না৷ বসিরহাট ও সংলগ্ন অঞ্চলের মুসলিমরা বরং আশঙ্কায় আছেন, এর পর নতুন করে তাঁদের ওপর হামলা না হয়৷
এবং বারবার একটা প্রশ্ন উঠে আসছে এই অশান্তির আবহে৷ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা আদতে হয়নি, কিন্তু দাঙ্গা হলে কাদের লাভ?