ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার
২১ মার্চ ২০১৯আগ্রহ বাড়ছে
তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার মগরাহাটের বাসিন্দা পল্লবী চক্রবর্তী৷ পল্লব থেকে পল্লবী হয়েছেন তিনি৷ যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি সদ্য কলকাতা পুলিশে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি পেয়েছেন৷ রূপান্তরকামী পল্লবী চক্রবর্তী তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছেন৷ ভোটার কার্ডের পাশাপাশি তাঁর আধার কার্ড, প্যান কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্সও রয়েছে৷ ভোটার কার্ড পেতে বা ভোট দিতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন যেভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য প্রশস্ত হচ্ছে, তাতে রূপান্তরকামীরা সাহস পাচ্ছেন৷ তাই তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা কিছুটা হলেও বাড়ছে বলে মনে হয়৷ আমার রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর অধিকাংশই ভোটার কার্ডে নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে দেখতে চান৷ স্বপরিচয় নিয়ে সকলের আগ্রহ তো বাড়ছেই৷''
ভোটার কি সত্যিই আশানুরূপ বেড়েছে?
পাঁচ বছরে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই৷ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সারা দেশে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মোট ভোটার ছিলেন ২৮,৫২৭ জন, যা এ বারের লোকসভা নির্বাচনের আগে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮,৩২৫৷ কিন্তু বাস্তব আর পরিসংখ্যানের ফারাক যে অনেকটা সেটা স্বীকার করেন অনেকেই৷ রূপান্তরকামী আইনজীবী অঙ্কন বিশ্বাস বলেন, ‘‘ পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নিরন্তর শহরে সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছে৷ তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আজ যা বেড়েছে সেটা এ জন্যেই সম্ভব হয়েছে৷ কিন্তু গ্রামেগঞ্জে এই নিয়ে কোনো কাজ হয় না৷ ফলে সে দিকটা অন্ধকারে আছে৷ তার কোনো পরিসংখ্যান নেই৷''
ইসলামপুরের লোক আদালতের রূপান্তরকামী সদস্য বিচারক জয়িতা মণ্ডল অবশ্য মনে করেন, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার কার্ডে নাম নথিভুক্ত করার পদ্ধতিটি জটিল, সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ৷ এ জন্য অনেকেই নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত হিসেবে দেখাতে পারছেন না৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিছু কিছু জায়গায় নাম বা লিঙ্গ পরিবর্তন সহজেই হচ্ছে৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আইনজীবীরা লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রোপচারের নথি দেখতে চাইছেন৷ ফলে তালিকায় অন্ততপক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার অনুপস্থিত৷ তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেরই আধার কার্ড রয়েছে৷ কিন্তু ভোটার কার্ড পেতে অসুবিধা হচ্ছে৷'' তিনি অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ আইনজীবী, অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারীই নালসা রায় সম্পর্কে জানেন না৷ ফলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট বা ম্যাজিস্ট্রেটের সার্টিফিকেট চেয়ে রূপান্তরকামীদের হেনস্থা করা হচ্ছে৷
২০১৪ সালের নালসা রায়ে বলা হয়েছিল, একজন রূপান্তরকামী নিজের পরিচয় নিজেই ব্যক্ত করতে পারেন৷ কোনো পরীক্ষা ছাড়াই৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পুরো উলটোটাই ঘটছে৷ সম্প্রতি এ কারণেই মাধ্যমিকের শংসাপত্রে তাঁর পল্লবী নামকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন শরীরে পুরুষ, মনে নারী পল্লবী চক্রবর্তী৷ তাঁর লিঙ্গান্তরের সার্জারি এখনো হয়নি৷ ফলে মাধ্যমিক বোর্ডে তিনি সার্জারির নথি জমা দেননি বলে তাঁর নাম পাল্টানো হচ্ছে না৷ পল্লবী ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত প্রমাণ করতে আদালতে হলফনামা পেশ করেছি৷ কলকাতা গেজেটে বিজ্ঞাপনও দিয়েছি৷ তাও মাধ্যমিকের নথিতে নাম বদল করা হচ্ছে না৷ আমার একটা যোগ্যতা আছে, সাধারণের মতো নিজের ইচ্ছানুযায়ী নাম নিতে পারছি না৷ নালসা রায় কেউ মানছেই না৷''
এমন ধরনের অভিযোগ অবশ্য শুধুমাত্র পল্লবীর একার নয়৷ আরও অনেকেরই৷ এবং এই একই কারণে ভোটার কার্ডে নিজেদের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করতে পারছেন না তাঁরা৷
অনেক অভিযোগ
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিলেন মাত্র ৪৯৯ জন৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে সেই সংখ্যাটা ছিল ৭৫৭৷ এ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪২৬ (গত জানুয়ারি পর্যন্ত)৷ কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, তৃতীয় বিশ্বের রাস্তায় রাস্তায়, ট্রেনে বাসে এত যে বৃহন্নলা দেখা যায়, তাহলে সেই নিরিখে তাদের সংখ্যাটা ভোটার তালিকায় এত কম কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা বলেন, ‘‘একটা ‘এলিট' শ্রেণি দেখাচ্ছে, রাজ্যে ট্রান্সজেন্ডারদের সংখ্যা কম৷ এটাও রাজনীতি৷ সংখ্যাটা কম দেখালে সংরক্ষণের প্রশ্ন থাকবে না৷ তাই ঠিক করে গণনা হচ্ছে না৷ সমীক্ষা ঠিক নয়৷ অস্থায়ীভাবে আমরা বলতে পারি এক লাখের উপর ট্রান্সজেন্ডার রয়েছে৷ এই সংখ্যাটা কোথায় গেল?৷''
সর্বোচ্চ আদালত ঐতিহাসিক রায়ে রূপান্তরকামীদের পুরুষ ও মহিলার বাইরে ভোটার তালিকায় শুধু তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, বরং দেশের কেন্দ্র ও সব রাজ্য সরকারকেও নির্দেশ দিয়েছিল এই তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের সরকারি চাকরিতে বিশেষ সুবিধা কিংবা ভোটার কার্ড, পাসপোর্টেরও ব্যবস্থা করতে হবে৷ দক্ষিণ ভারতের তুলনায় এ রাজ্য ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য সেভাবে কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করেন রঞ্জিতা সিনহা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে বা দেশে সঠিকভাবে কজন ট্রান্সজেন্ডার আছে, তার পরিসংখ্যান নেই৷ আমাদের নিষ্ক্রীয় করে রাখা হয়েছে৷ এই ভোটটাও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷ সঠিকভাবে ভোটারতালিকাই নেই৷''
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে রূপান্তরকামীদের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ ৮৮ হাজার৷ এ রাজ্যে ৩০ হাজার ৩৪৯ জন৷ অর্থাৎ রাজ্যে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষের সংখ্যার তুলনায় ভোটার তালিকার পরিসংখ্যান নেহাতই নগণ্য৷ আইনজীবী অঙ্কনের মতে, ‘‘সরকার কোনো গাইডলাইন দেয়নি৷ ফলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা নাম ও লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য কোন কোন রাস্তায় যাবেন, সেটাও পরিষ্কার নয়৷ একমাত্র হিজড়া পেশার সঙ্গে যুক্ত যারা, তাদের ক্ষেত্রেই তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়টা তুলে ধরা বাধ্যতামূলক৷ সবার ক্ষেত্রে এটা বাধ্যতামূলক নয়৷ ফলে হিজড়া পেশার বাইরের কেউ অনায়াসে নারী, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ বেছে নিতেই পারেন৷ ফলে বাস্তব আর ভোটার তালিকার পরিসংখ্যান আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা ১৬ আনা৷ এছাড়া লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের পরে নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গ না বলে নারী বা পুরুষের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন অনেকেই৷ সেটার জন্যও বাস্তব ও পরিসংখ্যানে ফারাক বাড়তে থাকে৷
সারা দেশে যেখানে ট্রান্সজেন্ডাররা রাজনীতিতে আসছেন, তার নিরিখে সমাজকর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, ২০১৪ সালে গত লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত কেন নামমাত্র সংখ্যাবৃদ্ধি হলো, কেন রূপান্তরকামী বা হিজড়াদের সঠিক প্রতিফলন ভোটার তালিকায় নেই? একটা টিকিটও তাঁদের দেওয়া হলো না কেন? জয়িতা মণ্ডল অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘যে রাজ্যে ভোটের মরশুমেও কোনো প্রার্থী ট্রান্সজেন্ডারদের কাছে তাদের অভাব, অভিযোগ জানতে চায় না৷ সেখানে আমরা ভোটে দাঁড়ালে কে ভোট দেবে? ভোটার তালিকায় সংখ্যাটা বাড়লেও সমাজটা এগোয়নি৷''
বন্ধু, প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷