তিন তালাক বিল : মোদী সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনীতি
১৫ আগস্ট ২০১৮বছরখানের পর দেশের সাধারণ নির্বাচন৷ শাসক দলের লক্ষ্য, তার ঠিক আগে ঝুলি থেকে বের করা হবে তিন তালাক বিল৷
ঢাক ঢাক গুড় গুড় ছিল৷ হলো না কিছুই৷ সংসদের বাদল অধিবেশনে একগুচ্ছ বিল পাশ হলো৷ প্রত্যাশিত থাকলেও রাজ্যসভায় পেশ হলো না ‘তিন তালাক' বিল৷ দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে লালকেল্লা থেকে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিন তালাক বিল নিয়ে বিরোধীদের দুষতে ছাড়লেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রীয় সরকার, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী তিন তালাক বিল পাশ করে আইনে রূপান্তর না হওয়ার জন্য বিরোধীদের ঘাড়ে দোষ চাপালেও এই বিল পাশ করাতে সরকারের সদিচ্ছা আছে কী? নাকি সবটাই রাজনৈতিক বেলুন? কারণ, বিল পেশ করার হলে দীর্ঘ এক মাসের বাদল অধিবেশনের যে কোনো দিন করানো যেত৷ তা না করে সরকার অধিবেশনের একেবারে শেষদিন (সপ্তাহে শুক্রবার বিল পেশের দিন নয়) তিন তালাক বিল পেশের কথা বললেও পরে কোনো অজানা কারণে তা পেশই করল না কেন?
মুসলিম সমাজে মেয়েদের বিয়েতে সুরক্ষা এবং তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সমাজে প্রচলিত তিন তালাক'-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে৷ সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে তিন তালাককে ‘অবৈধ' ঘোষণা করে৷ সরকারকে নতুন আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেয়৷ তারপর ‘মুসলিম ওম্যান প্রোটেকশন অফ রাইটস অন ম্যারেজ' বিল তৈরি করে ভারত সরকার৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফারহা ফয়েজ ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি, তিন তালাককে নির্বাচনী ইস্যু করবেন না৷ রাজনীতি করবেন না৷ সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করার পর সরকার আইন আনতে চায়নি৷ তাদের বক্তব্য ছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই যথেষ্ট৷ আইনের প্রয়োজন নেই৷ আদালতে আমরা বলেছিলাম, আইন না থাকলে নির্যাতিতা কোন আইনে অভিযোগ দায়ের করবে? এরপর সুপ্রিম কোর্ট যখন বলল, আইন তৈরি করা উচিত, তারপর সরকারের টনক নড়ল৷ কিন্তু, ভারতের দুর্ভাগ্য, এরপরেও রাজনীতি শুরু হয়েছে৷ সরকার যা চেয়েছিল, তা-ই করছে৷''
ফারহা মনে করেন, তিন তালাকে অভিযুক্ত স্বামীর কারাদণ্ড হওয়া উচিত৷ তা না হলে মানুষের মনে ভয় হবে কী করে? মুসলিম মহিলাদের জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া আইনজীবীর আক্ষেপ, ‘‘১৯৮৬ থেকে লড়াই চলছে৷ তিন তালাক, বহুবিবাহ ও নিকাহ হালালা ইত্যাদি নিয়ে আজীবন লড়াই করেই যাব? সরকার যদি সত্যিই মুসলিম মহিলাদের ভালো চাইতো, তাহলে শুরুতেই সম্পূর্ণ আইন আনতো৷ তা না করে সময় নষ্ট করে রাজনীতি করার উদ্দেশ্য পূরণ করা হচ্ছে৷ তবে, আমাদের আইন চলবে৷''
গতবছরই তিন তালাক বিষয়ক অধ্যাদেশ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তারপর তা লোকসভায় বিল পেশ হয়৷ পাশ হয়৷ এখন উচ্চকক্ষের অনুমোদনের জন্য বিলটি রাজ্যসভায় রয়েছে৷ রাজ্যসভায় বিরোধীরা শক্তিশালী৷ বিরোধী দলগুলো প্রস্তাবিত বিলে অভিযুক্ত স্বামীর জামিনের বন্দোবস্ত রাখার দাবি জানিয়েছে৷ অনেক টালবাহানার পর শেষমেশ বিরোধীদের দাবি মেনে সেই বন্দোবস্তের পথ খোলা রেখেই বিলটি আনতে চাইছে সরকার৷
কয়েক দশক ধরে নারী সুরক্ষা ও নারী স্বাধীনতার জন্য গণতান্ত্রিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ‘সাউথ কলকাতা সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন'৷ সংগঠনের নেত্রী আফরোজা খাতুন ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেই তালাক বন্ধ করার দাবি উঠেছিল৷ সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে ২০১৪ সালের পর বিজেপি মুসলিম মহিলাদের ‘রক্ষা করা'র জন্য উঠেপড়ে লাগল৷ তারপর ধীরে ধীরে সামাজিক লড়াই পরিণত হলো দুটি মৌলবাদী শক্তির লড়াইয়ে৷ হিন্দু মৌলবাদীরা বলতে চাইছে, ওদের (মুসলিম) হাত থেকে ওদের মহিলাদের রক্ষা করব৷ আবার উলটো দিকে, মুসলিম মৌলবাদীরা ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে ‘গেল, গেল' রব তুলছেন৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, সুপ্রিম কোর্ট বা প্রস্তাবিত আইনে তাৎক্ষণিক তালাকের কথা বলা হয়েছে৷ সরল সমীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে৷''
মোদী সরকারের প্রস্তাবিত তালাক বিল নিয়ে আফরোজা আরো জানাচ্ছেন, ‘‘লোকসভায় তালাক বিল পাশ হয়ে গেল৷ সেই বিল সুপরিকল্পিত একটি চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়৷ মৌখিক তালাক দিলে যদি স্বামীকে গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে তো তালাকটা মেনে নেওয়া হলো৷ আদালত তো বলছে মৌখিক তালাক গ্রাহ্য নয়৷ তা সত্ত্বেও এই বিলটিকে স্বচ্ছ করার দাবি জানানো হয়েছিল৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে যত নির্বাচন এগিয়ে আসছে, ততই সব রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের মাথা, পীর হুজুরদের তুষ্ট করার পথে হাঁটতে শুরু করেছে৷ ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই তালাক ইস্যুটাই রাজনৈতিক খেলনায় পরিণত হয়েছে৷''
প্রস্তাবিত এই আইনের খসড়া বিলে বলা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে মৌখিক, লিখিত অথবা ডিজিটাল উপায়ে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে, তা অপরাধ হিসেবে গন্য হবে৷ শুধু তাই নয়, জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে৷ অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছরের কারাদণ্ড৷ তিনমাস আগে তিন তালাক অধ্যাদেশ জারি করেছিল ভারত সরকার৷ লোকসভায় বিলটি পাশ হয়েছে৷ আটকে রয়েছে রাজ্যসভায়৷ কিন্তু, শেষবেলায় ‘তিন তালাক' বিল সংসদে পেশ করলই না নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ লক্ষ্য, কংগ্রেস, তথা সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর দিকে আঙুল তোলা৷ এখন অনুমান করা হচ্ছে, ২০১৯-এর আগে মুসলিম মহিলা ভোটব্যাঙ্কের দিকে নজর রেখে আগামী শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি পাশ করানোর সবরকম চেষ্টা চালাবে নরেন্দ্র মোদী সরকার৷
উল্লেখ্য, এর আগে লোকসভায় বিলটি পেশ হলে বিরোধী দল কংগ্রেস সমর্থন দিলেও ‘শাস্তি'র বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে বিলটিকে ‘সিলেক্ট কমিটি'তে পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল৷ কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী সরকার তাতে রাজি হয়নি৷ তাদের বক্তব্য, কমিটিতে পাঠানো হলে বিল পাশ হয়ে আইনে রূপান্তর হতে অনেক সময় লেগে যাবে৷ রাজনীতির ‘খেলায়' বদল আনে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা৷ এই কক্ষে এনডিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই৷ ফলে, একক শক্তিতে কোনো বিল পাশ করা সম্ভব নয়৷ ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই কক্ষে সুর নরম করতে হয় সরকারকে৷ তিন তালাক বিলের শাস্তি দেওয়ার জায়গায় সংশোধন করে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন তাহলে অভিযুক্তকে জামিন দিতে পারেন৷ সেইসঙ্গে বলা হয়েছে, নির্যাতিতা ও তাঁর আত্মীয়রা অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারবেন৷ এতকিছুর পর সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ছিল, সরকার চাইলেও বিরোধী পক্ষের বাধার মুখে পড়তে পারে তিন তালাক বিল৷ যদিও বাস্তবে দেখা যায়, বিরোধীদের বাধার আশঙ্কায় বিলটি পেশ করল না সরকারই! কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর দিকে তোপ দাগতেও ছাড়েননি৷ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নাইডু জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য হয়নি৷ তাই তিন তালাক বিল এবার আর আসছে না৷
তবে, শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই বিরোধীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় সারতে চাইলেও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রবীন নেতা জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, ‘‘ আসলে ‘তিন তালাক' বিল নিয়ে আসার পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য অন্য৷ এই বিলে মুসলিম মহিলাদের বিশেষ কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না৷ কিন্তু, শাসক দল পুরোপুরি রাজনীতি করতে চায়৷''