তন্ময়েরা ছড়িয়ে আছেন সব দলেই, ব্যবস্থা নিক সকলেই
২৮ অক্টোবর ২০২৪একটি বাংলা পোর্টালের এক নবীন নারী সাংবাদিক রোববার ফেসবুক পোস্ট করে অভিযোগ করেছেন, প্রবীণ সিপিএম নেতা তন্ময় ভট্টাচার্য তাকে যৌন হেনস্থা করেছেন। ফেসবুক পোস্টে তার অভিযোগ, সাক্ষাৎকার নিতে তন্ময়ের বাড়িতে গেছিলেন তিনি। সেখানে ওই প্রবীণ নেতা নারী সাংবাদিকের কোলে বসে পড়েন।
স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা অনভিপ্রেত। একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা একজন পেশাদার সাংবাদিকের কোলে বসে পড়বেন, এ কোনো কাজের কথা নয়। বোঝাই যায়, যিনি এ কাজ করেছেন, তার উদ্দেশ্য ভালো নয়। বস্তুত, ওই নারী সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, এর আগেও ওই নেতা তার গায়ে হাত দিয়েছেন। এমনভাবে ছুঁয়েছেন, যা তার ভালো লাগেনি। গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ নিয়ে ইদানীং বহু আলোচনা হয়। ওই নারী সাংবাদিক বুঝতে পেরেছেন, তন্ময়ের ছোঁয়া গুড চাট নয়।
যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। রোববার সন্ধ্যায় ওই সাংবাদিক বরানগর থানায় লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন। তবে তার আগেই সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আরেক নেতা সুজন চক্রবর্তীকে পাশে বসিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তন্ময়ের বিরুদ্ধে দল তদন্ত কমিটি তৈরি করছে। সেখানে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত হবে। সেই কমিটি সিদ্ধান্ত জানানো পর্যন্ত তন্ময়কে দল সাসপেন্ড করছে। সেলিম জানিয়েছেন, তন্ময়ের বিরুদ্ধে আগেও কিছু অভিযোগ উঠেছিল, তারও তদন্ত করবে দল।
অন্যদিকে তন্ময় জানিয়েছেন, তিনি নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। ওই নারীর সঙ্গে তার বহুদিনের আলাপ। ঠাট্টা করেছেন। কিন্তু যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা তিনি করেননি।
ঘোলা জলে রাজনীতি
যত দিন যাচ্ছে, বঙ্গ রাজনীতির জল তত কর্দমাক্ত হচ্ছে। এমন নয় যে, আগেও তা খুব পরিষ্কার ছিল। তবে ইদানীং কাঁদার পরিমাণ বেড়েছে সন্দেহ নেই। রোববার ওই সাংবাদিকের পোস্ট ভাইরাল হতেই আসরে নেমে পড়েছেন তৃণমূল, বিজেপির নেতারা। সকলেই তন্ময়ের পাশাপাশি বামপন্থি আদর্শের প্রশ্ন তুলছেন।
প্রশ্ন এখানেই। তন্ময় যা ঘটিয়েছেন, তা যে তিনি দলের নির্দেশে করেননি, তা পরিষ্কার। সিপিএম যেভাবে দ্রুত সাংবাদিক বৈঠক করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। এবং এই প্রথম নয়, এর আগে দলের আরেক নেতার বিরুদ্ধেও সিপিএম ঠিক এভাবেই ব্যবস্থা নিয়েছিল। সে সময় দলের গুরুত্বপূর্ণ তরুণ নেতা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অত্যন্ত স্নেহভাজন ঋতব্রত ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধেও যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল। দল তাকেও সাসপেন্ড করেছিল এবং পরে বহিষ্কার করে। সেই নেতা অবশ্য এখন তৃণমূলের দ্বিতীয় সারির নেতা হয়ে বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছেন।
অন্যরা কী করেন?
রোববার ওই নারী সাংবাদিকের ফেসবুক পোস্ট দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর ছয়েক আগের কথা। রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে তখন নিয়মিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসে যাতায়াত ছিল। বিজেপি অফিসের নিচে আলাপ হয়েছিল এক নারীর সঙ্গে। সাংবাদিকের কাছে কার্যত প্রার্থনা করেছিলেন তিনি তৎকালীন রাজ্য সভাপতির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার। দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে ওই নারী একাধিকবার যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন। পেশার সূত্রেই ওই নারীর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। যার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল, তার সঙ্গেও আছে। মনে আছে, ওই নারীর অভিযোগ ঘিরে সে সময় বিজেপির অন্দরে রীতিমতো আলোড়ন উঠেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত দল কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি। দলের তৎকালীন নেতারা বরং উল্টে ওই নারীকেই কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, অন্য এক ঘটনায় বিজেপির দুই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে হোটেলে নিয়ে গিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছিলেন দলেরই এক নারী কর্মী। এখন আর সেই নেতা বাংলায় বড় একটা আসেন না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলে তাদের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। আরো বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের। কিন্তু ওই নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে সামান্য তদন্তটুকু পর্যন্ত হয়নি।
তৃণমূল তথৈবচ
তৃণমূলের বহু নেতার বিরুদ্ধে বহু সময় নানা অভিযোগ উঠেছে। যে তৃণমূল এক সময় সিপিএম নেতা ঋতব্রত ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে, সেই তৃণমূলই তাকে সাদরে দলে গ্রহণ করেছে। বলা ভালো আশ্রয় দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে সন্দেশখালির মতো অভিযোগ আছে। বহু নারী প্রকাশ্যে এই সমস্ত অভিযোগ করেছেন। কী ব্যবস্থা নিয়েছে দল? প্রবল রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপ তৈরি হওয়ার আগে তারা তো শেখ শাহজাহানকেও আড়াল করার চেষ্টা করেছিল! দলের স্থানীয় নেতারাই তা স্বীকার করেন! রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে আরো শাহজাহান ছড়িয়ে আছে, দলের নেতারা একান্ত আলাপচারিতায় তা স্বীকার করেন। ব্যবস্থা নেন না কেন?
পেশাগত বিপদ
রোববার এই ঘটনা ঘটার পর এক দীর্ঘদিনের সহকর্মী নারী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একাধিক বিটে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার সঙ্গে। মনে পড়ে কোনো কোনো নেতার ঘরে ঢোকার সময় সে পুরুষ সহকর্মীদের কাছে আবদার করতো সঙ্গে যাওয়ার জন্য। সরকারি অফিসার থেকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী নারী সাংবাদিকদের হেনস্থা হতে হয়েছে অনেকের কাছেই। কিন্তু সব সময় প্রকাশ্যে তারা মুখ খুলতে পারেননি। অফিসে অভিযোগ জানালে বলা হয়েছে, এ হলো পেশার বিপদ। সব সময় এড়ানো যায় না। ফলে প্রবল বিবমিষা নিয়েই তাদের দিনের পর কাজ করে যেতে হয়েছে। অপছন্দের ব্যক্তির কাছে ফিরে যেতে হয়েছে বার বার। এই নারীর সঙ্গেও তার অফিস যে সে কাজ করেনি, তা আশাপ্রদ। ফেসবুক পোস্টে এই নারী সাংবাদিক জানিয়েছেন, তার অফিস তার পাশে দাঁড়িয়েছে। এটি আশার কথা।
মনে পড়ছে, এই কলকাতাতেই এমন খবরের কাগজ এখনো আছে, যেখানে নারী রিপোর্টার নেয়া হয় না। কারণ ওই সংবাদপত্র এই একুশ শতকে পৌঁছেও মনে করে, নারী রিপোর্টাররা রাস্তায় নামলে তাদের সম্মানহানি হতে পারে। পুরুষের মতো তারা লড়ে নিতে পারবেন না। নারীদের নিয়ে একটি সংবাদপত্রের যদি এই মানসিকতা হয়, তাহলে বাকি সমাজের অবস্থা বোঝাই যায়!
রাজনৈতিক কুচক্র
পশ্চিমবঙ্গে এখন সব বিষয়ই রাজনৈতিক। এক আনা মুনাফা তুলতে পাঁক ঘাটতেও তৈরি নেতারা। ফলে এই ঘটনাটি নিয়েও রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। সামনেই বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন। ফলে প্রচারে এই ঘটনাটিকে অস্ত্র করার চেষ্টা করবেন অনেকেই। যদি করেন, তাহলে বার বার অপমান করা হবে ওই নারীকে, এই কথাটি বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে। সব বিষয় যে মঞ্চ কাঁপানোর জন্য নয়, রাজনীতির লোকেরা যত দ্রুত তা বুঝতে পারবেন, ততই সমাজের মঙ্গল।