ঢাকাই ছবিতে ঈদ উৎসবের হাওয়া
১১ এপ্রিল ২০২৪ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমার সংখ্যা দেখলে কথাটা কারো কাছেই হয়ত খুব ভুল মনে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এবারের ঈদ উৎসবে সিনেমা মুক্তির এমন হিড়িকের কারণ কী?
দুই-তিন বছর ধরে প্রতি ঈদেই সিনেমা মুক্তির মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। এবারও একই চিত্র। আজ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বড় পর্দায় এসেছে প্রায় ডজনখানেক সিনেমা। সংখ্যাটা ১৩ হওয়ার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে ২টি সিনেমা সরে যাওয়ায় ডজন পূর্ণ হয়নি। তাতেও সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে! এক ঈদেই সিনেমা মুক্তি দিতে প্রযোজক-পরিচালকদের মাতামাতি অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। সিনেমা পাড়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় চর্চিত হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। এর কারণ দেশে সিঙ্গেল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহ কম থাকা এবং ব্যবসায় ভাটা পড়ার শঙ্কা।
ঈদ উৎসবে সব মিলিয়ে প্রেক্ষাগৃহ চালু থাকবে ১৮০-২০০টি। এর মধ্যে একটি সিনেমার দখলে থাকছে ১২৫টির বেশি! বাকি ১০টি সিনেমাকে অল্পসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ১১টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এগুলো হলো– গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা', মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘ওমর', হিমেল আশরাফের ‘রাজকুমার', মিশুক মনি পরিচালিত ‘দেয়ালের দেশ', কামরুজ্জামান রোমানের ‘মোনা: জ্বীন-২' ও ‘লিপস্টিক', জসিম উদ্দিন জাকিরের ‘মায়া: দ্য লাভ', জাহিদ হোসেনের ‘সোনার চর', কাজী হায়াতের ‘গ্রিন কার্ড', ছটকু আহমেদের ‘আহারে জীবন' এবং ফুয়াদ চৌধুরীর ‘মেঘনা কন্যা'। এগুলোর মধ্যে ঢালিউডে সুপারস্টার তকমা পাওয়া শাকিব খানের ‘রাজকুমার' একাই ১২৭টি প্রেক্ষাগৃহে চলবে। ঈদে মুক্তির ঘোষণা দেওয়া সিনেমার তালিকায় আরো ছিল আহমেদ হুমায়ূনের ‘পটু' ও মো. ইকবালের ‘ডেড বডি'।
গত এক দশকের চিত্র বলছে, ঈদ আর শাকিব খানের সিনেমা সমার্থক হয়ে গেছে। তার সিনেমা মানেই টেবিল মানির গ্যারান্টি! একসময় এক ঈদেই এই তারকার চার-পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেতো। কিন্তু তিনি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন বলে করোনার পর থেকে এক ঈদে নিজের একটির বেশি সিনেমা মুক্তির সুযোগ রাখছেন না। এবারের ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ১১টি সিনেমার মধ্যে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের মধ্যে ‘রাজকুমার' নিয়েই আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। বুকিং এজেন্টদের অনুমান, ৮০ ভাগ প্রেক্ষাগৃহে এই সিনেমার দাপট থাকবে।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রেক্ষাগৃহ মধুমিতা ‘রাজকুমার' চালাচ্ছে। মধুমিতার ৫৫ বছরের ইতিহাসে সর্বাধিক আয় করা সিনেমার মধ্যে শাকিবের ‘প্রিয়তমা' এগিয়ে। একই নায়ক, পরিচালক ও প্রযোজকের সিনেমা ‘রাজকুমার'। ভার্সেটাইল মিডিয়ার ব্যানারে আরশাদ আদনানের প্রযোজনায় এটি পরিচালনা করেছেন হিমেল আশরাফ। মধুমিতা প্রেক্ষাগৃহের স্বত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের কথায়, ‘‘আমাদের দেশে নায়ক-নায়িকাই তো নাই। শাকিব ছাড়া আর কেউ এককভাবে দর্শক টানতে পারে না। সিনেমা এখন শাকিবকেন্দ্রিক।''
এবারের ঈদের ১১টির মধ্যে চারটি সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশার পারদ উঁচুতে। এরমধ্যে ‘রাজকুমার' ছাড়া বাকি তিনটিতেই প্রধান চরিত্রে আছেন ‘পরাণ' ও ‘হাওয়া' তারকা শরিফুল রাজ। শাকিব খান ছাড়া খুব কম নায়কের বেলায় একই ঈদে তিনটি সিনেমার মুক্তি দেখেছে ঢালিউড। চিত্রনায়ক শরিফুল রাজের নতুন তিনটি সিনেমা হলো ‘ওমর', ‘দেয়ালের দেশ' ও ‘কাজলরেখা'। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমত খুব ভালো লাগছে, কারণ উৎসবের আমেজ পাচ্ছি। যদিও এটা আমার পরিকল্পনায় ঘটেনি। ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করলে, যদি এক-দুটি সিনেমা ঈদের পরে আসতো তাহলে কিছুটা চাপমুক্ত থাকা যেতো। সিনেমার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আমি অবশ্যই চাইবো না, সিনেমা শুধু ঈদেই ব্যবসা করুক। সারাবছর বাংলা সিনেমা এলে দর্শকদের একটা অভ্যাস হবে। তা না হলে তারা শুধু ঈদেই বাংলা সিনেমা দেখবে। যেহেতু এক ঈদে আমার তিনটি সিনেমা এসে গেছে, তাই এখন এটা উপভোগ করছি।''
‘ওমর' সিনেমার পরিচালক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দর্শক সাধারণ সময়ে প্রেক্ষাগৃহে এলে নির্মাতারা ভরসা পেতেন। উৎসবের মেজাজ ছাড়া ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে প্রেক্ষাগৃহে যেতে চায় না বেশিরভাগ মানুষ। তবে এটাও ঠিক যে, কন্টেন্ট ভালো হলে কোনও দিনক্ষণ লাগে না। যেমন ‘হাওয়া' ঈদ ছাড়াই মুক্তি পেয়ে সফল হয়েছে।”
করোনার আগ পর্যন্ত একেক ঈদে ঢালিউডের সর্বোচ্চ পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এরপর থেকেই ঈদকেন্দ্রিক হতে শুরু করেন দেশীয় প্রযোজক-পরিচালকেরা। গত একদশকের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী– ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে ৮টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি, ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরে ১টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি, ২০২০ সালের ঈদুল ফিতরে ১টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি, ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৮ সালের ঈদুল ফিতরে ৫টি ও ঈদুল আজহায় ৪টি, ২০১৭ সালের ঈদুল ফিতরে ১টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতরে ৩টি ও ঈদুল আজহায় ৩টি, ২০১৪ সালের ঈদুল ফিতরে ৪টি ও ঈদুল আজহায় ৫টি নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
এবারের ঈদে সিনেমা মুক্তির হিড়িক গত একদশকের তুলনায় অনেক বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকাই সিনেমা মূলত দুটি কারণে ঈদকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ঈদ ছাড়া প্রেক্ষাগৃহে আশানুরূপ দর্শক সমাগম না হওয়া এবং ঈদ ব্যতিত বছরে ১০টি হিন্দি সিনেমা আমদানির নীতিমালা থাকা। যদিও গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ‘জওয়ান' ছাড়া কোনও হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে আহামরি ব্যবসা করেনি।
ঈদ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে তারকাবহুল বড় বাজেটের সিনেমা ছাড়তে চান না নির্মাতারা। ঈদেই সিনেমা মুক্তি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। শুটিং শুরুর সময় ঈদ লক্ষ্য না থাকলেও মুক্তি দেওয়ার বেলায় এই উৎসবই বেছে নিচ্ছেন তারা। এবারও সেই প্রবণতা লক্ষণীয়। ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ১১টি সিনেমার মধ্যে কেবল ২টি (রাজকুমার, ওমর) ঈদকে লক্ষ্য রেখে তৈরি হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ‘কাজলরেখা' ও ‘দেয়ালের দেশ' গত ফেব্রুয়ারিতে মুক্তির কথা থাকলেও শেষমেষ ঈদকে লক্ষ্য করা হয়। বাকি ৭টি সিনেমাই ঈদের জোয়ারে গা ভাসাতে এসেছে।
‘কাজলরেখা'র পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের প্রথম ও একমাত্র ব্যবসাসফল সিনেমা ‘মনপুরা' ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়ে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। তাহলে তিনি কেন ঈদের ম্যারাথনে যোগ দিলেন? সিনেমাটির প্রেস মিটে তার যুক্তি ছিল, "ঈদের তিন দিন পরেই পহেলা বৈশাখ। সেজন্যই ঈদে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া। ‘কাজলরেখা' মূলত বৈশাখের সিনেমা।”
ঈদ উপলক্ষে বড় পর্দার হালচাল নিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা যায়। প্রযোজক-পরিচালকদের বিশ্বাস, উৎসবের আমেজে অনেকে দলবেঁধে ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে ভিড় করেন। তাদের বেশিরভাগই অনিয়মিত অর্থাৎ বছরের অন্যান্য সময় তারা প্রেক্ষাগৃহবিমুখ থাকেন। বাড়তি দর্শকের জোয়ার ধরতেই কয়েক বছর ধরে ঢাকাই সিনেমা কার্যত ঈদকেন্দ্রিক। তাছাড়া ঈদে সিনেমা মুক্তির ঘোষণা দিয়ে তুলনামূলক বেশি আলোচনায় থাকার কৌশল অবলম্বন করেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। ব্যবসা হোক না হোক, ঈদে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে লাইমলাইটে থাকাটাই যেন মুখ্য। এবারের ঈদুল ফিতরের সিনেমাগুলো নিয়েও যথারীতি জোর আলোচনা হয়েছে। ঢালিউডে ঈদকে ঘিরে আলোচনা বাড়লেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত কয়টি সিনেমা দর্শক টানতে পারে সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
গত একদশকের হিসাবে, ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা আলোচনায় থাকলেও বেশিরভাগের মূলধন উঠে আসেনি। কোনোটির তো বিনিয়োগের ১০ শতাংশও ফেরত পাননি লগ্নিকারী প্রযোজক। প্রেক্ষাগৃহ মালিক, পরিবেশক ও বুকিং এজেন্ট সূত্রে জানা যায়, গত দুই-তিন বছরে ঈদে মুক্তি পেয়েও ‘প্রিয়তমা', ‘পরাণ' ও ‘সুড়ঙ্গ'র মতো আর কোনও সিনেমা আহামরি ব্যবসা করতে পারেনি। বাদবাকি বেশিরভাগই মোটাদাগে ব্যর্থ। এত লোকসানের পরও ঈদে সিনেমা মুক্তি দিতে কেন মরিয়া প্রযোজক-পরিচালকেরা? কারণ ঈদেই যা একটু সম্ভাবনার আলো দেখেন তারা। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত সিনেমা হাউসফুল থাকলে দর্শকেরা টিকিট কেটে প্রেক্ষাগৃহে অন্য সিনেমা দেখেন। ফলে পুঁজি ফেরত না এলেও ঈদে অন্তত দুই সপ্তাহ আলোচনায় থাকা যাচ্ছে! তাদের বদ্ধমূল ধারণা, বছরের অন্য সময়ে সিনেমা মুক্তি দিলে খুব একটা নজরে আসা সম্ভব হয় না।
গত একদশকে ঈদ উৎসব ছাড়া অন্য সময় মুক্তি পাওয়া সিনেমা বলার মতো ব্যবসা করতে পারেনি। ব্যতিক্রম ঘটনা যে নেই তা কিন্তু নয়। ভালো গল্প, চিত্রনাট্যের বুনন, নির্মাণশৈলী, অভিনয় নৈপুণ্য, মনকাড়া গানসহ বিভিন্ন উপকরণের সম্মিলন ঘটলে অন্য সময়ে মুক্তি পেয়েও সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার নজির রয়েছে। গত ১০ বছরে ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়ে দারুণ ব্যবসা করতে পারা সিনেমার তালিকায় রয়েছে ‘হাওয়া' (২০২২), ‘দেবী' (২০১৮), ‘ঢাকা অ্যাটাক' (২০১৭), ‘আয়নাবাজি' (২০১৬)। সংখ্যাটা যদিও বড় নয়। গত বছর ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়ে দর্শকদের মন জয় করেছে ‘১৯৭১ সেই সব দিন' ও ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার'।
দেশের পাশাপাশি দুই-তিন বছর ধরে বিদেশের বাজারে ঢাকাই সিনেমার কদর বেড়েছে। ‘হাওয়া', ‘প্রিয়তমা', ‘পরাণ', ‘দেবী' দেদার চলেছে আমেরিকা-ইউরোপে। কানাডা, আমেরিকা ও আরব আমিরাতে ‘রাজকুমার', কানাডা ও আমেরিকায় ‘কাজলরেখা', ইউরোপ ও আমেরিকায় আসছে ‘ওমর'।
তবে শুধু ঈদকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে বিদেশের বাজার ঝুঁকিতে পড়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক পরিবেশক স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৈকত সালাহউদ্দিন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে বিদেশে এখন ১৫০টি প্রেক্ষাগৃহে ঢাকাই সিনেমা মুক্তি দিতে পারছি আমরা। কিন্তু সেই বাজার নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ কোনও সিনেমার মুক্তির তারিখ পিছিয়ে গেলে বিদেশের মাল্টিপ্লেক্স চেইনগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করে। অথচ ঈদে মুক্তির আশায় আমাদের নির্মাতারা একের পর এক তারিখ ঘোষণার পর পিছিয়ে যান। ঈদে সিনেমা মুক্তি দেওয়া এখন কারও কারও কাছে যেন স্ট্যাটাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমা এখন ক্রিকেটের মতো ইভেন্ট হয়ে গেছে। আমাদের শীত, বর্ষা, বসন্তসহ সারাবছর বৈচিত্র্যময় উৎসব আছে। তাই ঈদে কেন্দ্রীভূত না থেকে নিয়মিতভাবে সিনেমা মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। নির্দিষ্ট সময়ে ঘোষণা দেওয়া, প্রচারণা চালানো, কন্টেন্ট মানসম্পন্ন হওয়া– এসবের সম্মিলনের সঙ্গে দর্শক সমাগম হলে সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বললে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে সারাবছর সিনেমার চাহিদা থাকে প্রেক্ষাগৃহ মালিক ও পরিবেশকদের। কিন্তু তারা সেটা পাচ্ছেন না।'
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির হিসাবে, ব্যবসায় মন্দার কারণে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৪৬০ থেকে নেমে দাঁড়ায় ৫০টিতে। ঢিমেতালে থাকা আরও ১০০টি প্রেক্ষাগৃহ মুনাফার আশায় কেবল ঈদ উপলক্ষে চালু হয়ে থাকে। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সের ৩৫টি প্রেক্ষাগৃহ। বাকিগুলো তালাবদ্ধ নয়তো বহুতল শপিংমল ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, পুরান ঢাকার চিত্রামহল ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
ঈদের সময় চালু রেখে সারাবছর বন্ধ রাখার কারণ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা তো শখে বন্ধ রাখছি না। সিঙ্গেল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহে চালানোর মতো কন্টেন্ট নাই বলেই বন্ধ রাখতে হয়। ঈদের সিনেমা দেখানো শেষে তাই আবার বন্ধ হয়ে যায় শতাধিক প্রেক্ষাগৃহ। কারণ বছরের অন্যান্য সময়ে দর্শক খরায় প্রতি মাসেই কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। আমি যেমন পেরে না উঠে মধুমিতার কর্মী কমিয়ে ফেলেছি।'
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল মনে করেন, এক ঈদে এত সিনেমা একসঙ্গে ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। তিনি ডয়চে ভেলের কাছে উল্লেখ করেন, ঈদ উপলক্ষে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ২০০ স্পর্শ করবে। তবে ঈদের পর এতসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহ চালু রাখা কঠিন মানছেন তিনি। তার মন্তব্য, ‘দুই-একটি সিনেমা হিট হলে ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখা যায় না। বছরে সাত মাসই সিনেমা থাকে না। অথচ এক ঈদে ১১-১২টি সিনেমা এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এত সিনেমা দেখা দর্শকদের জন্য কঠিন। তাদেরও তো সময়-সুযোগ দিতে হবে নাকি? প্রতি ঈদে তিন-চারটি সিনেমা এলে শান্তি নিয়ে দেখা যায়। সিনেমা বেশি এলে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু লোকসান হয় প্রযোজক-পরিচালকদের। তারা না বুঝলে তো কিছু করার নাই।'
একই সুরে ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ যোগ করেন, এক ঈদে ১১টি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার ঘটনা প্রেক্ষাগৃহ মালিক কিংবা দর্শক কারও জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। তার মতে, বছর জুড়ে ভালো সিনেমা মুক্তির বিকল্প নেই। ঈদ ছাড়া অন্য সময়ে সিনেমা ব্যবসা না করার পেছনে মানহীন গল্পের দায় দেখেন তিনি। তার মন্তব্য, "একসময় বছর জুড়ে সিনেমার লাইন পড়ে যেতো। আর এখন তো সিনেমাই তৈরি হচ্ছে না। আর যেগুলো হচ্ছে সেগুলো এত মানহীন যে, প্রেক্ষাগৃহে চলার যোগ্য না। সাতদিন ধরে দর্শক টানার উপকরণ থাকে না বেশিরভাগ সিনেমায়। ‘প্রিয়তমা', ‘হাওয়া', ‘পরাণ', ‘সুড়ঙ্গ'র মতো ভালো কন্টেন্ট ঈদ ছাড়াও ঠিকই চলবে।”
সিঙ্গেল স্ক্রিনের চেয়ে মাল্টিপ্লেক্সে তুলনামূলক বেশি ভরসা রাখছেন নির্মাতারা। এক্ষেত্রে দেশের সব প্রযোজক-পরিচালকের কাছেই স্টার সিনেপ্লেক্স বহুল প্রত্যাশিত। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে সাতটি শাখায় ১৯টি পর্দা আছে অভিজাত মাল্টিপ্লেক্সটির। ঈদের ১১টি সিনেমার মধ্যে ৮টি দেখানো হচ্ছে এগুলোতে। এরমধ্যে ‘রাজকুমার', ‘ওমর', ‘কাজলরেখা', ‘দেয়ালের দেশ' ও ‘মোনা: জ্বীন-২' বেশি শো-টাইম পেয়েছে।
স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া ও বিপণন বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘হিন্দি সিনেমার ভয়ে দেশীয় নির্মাতারা ঈদেই সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন, এটা আমি মানতে রাজি নই। ঈদ ছাড়া বাংলা সিনেমা দেখতে দর্শক সিনেপ্লেক্সে আসে না, এমন একটা ধারণা আছে নির্মাতাদের। এটা ঠিক যে, উপচেপড়া ভিড় শুধু ঈদেই দেখি। কিন্তু দুই ঈদ দিয়ে তো একটা ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের বাঁচাতে সারাবছর মানসম্পন্ন কন্টেন্ট দরকার।'
স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব উর রহমান কয়েকদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নির্মাতাদের সবসময় বলি, ঈদ কোলাহলপূর্ণ উৎসব। ঈদে সবাই একসঙ্গে সিনেমা মুক্তি দেওয়া সফল ব্যবসার কোনও নীতি হতে পারে না। কারণ স্টার সিনেপ্লেক্সে ব্যবসাসফল হওয়া বাংলা সিনেমার বেশিরভাগই ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়েছে। ঈদের সময় তাড়াহুড়া করে মুক্তি না দিয়ে সময় নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে অন্য যেকোনও সময় মুক্তি দিলে সিনেমা ভালো চলতে পারে। দুঃখজনক বিষয় হলো, সারাবছর আমরা ভালো সিনেমা পাই না। কারণ ঈদে সবাই একসঙ্গে সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন।'
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন। প্রযোজকদের নিয়ে কোনও কমিটি না থাকার কারণে সিনেমা মুক্তিতে শৃঙ্খলা রাখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য অনেকের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন– নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির উচিত, ঈদে সর্বোচ্চ চারটি সিনেমা মুক্তির একটি নিয়ম-নীতি ঠিক করা। এর অংশ হিসেবে অন্তত একমাস আগে সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে যথাযথ প্রচারণা চালানোর সুযোগ থাকবে। ফলে সারাবছর সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকবে। আখেরে লাভ হবে সবার। নয়তো ঈদের হরিষে ঢাকাই সিনেমার আকাশে বিষাদ ভর করার শঙ্কা বেশি!