1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টারজান ভিসা: প্রতারণা, দুর্ভোগ আর দুর্নামের অপর নাম

২৩ অক্টোবর ২০২০

‘টারজান ভিসা’ কাগজে-কলমে নেই, কিন্তু বাস্তবে আছে৷ উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশিরা টারজান ভিসার ঝুঁকি নিচ্ছে৷ বসনিয়ার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশিরাও এর শিকার৷

https://p.dw.com/p/3kLTR
বসনিয়ার মিরাল ক্যাম্পের ২৮ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীছবি: Arafatul Islam/DW

এরকম আরো অনেক ধরনের ভিসার নাম প্রচলিত আছে৷ ডলফিন ভিসা, ফ্রি ভিসা, বডি ভিসা...৷

‘বনের রাজা’ টারজান যেমন দড়ি বা লতা গুল্ম ধরে এক গাছ থেকে লাফিয়ে আরেক গাছে যায়, এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যায়, টারজান ভিসার বৈশিষ্ট্যও সেরকম৷ মানব পাচারকারীরা ইউরোপ বা এশিয়ার কোনো উন্নত দেশে চাকরি দেয়ার নামে যুবকদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যায় জাল ভিসায়৷ কখনো বিমানে, কখনো নৌকা বা জাহাজে, কখনো বাসে বা অন্য কোনো যানবাহনে৷ কখনো পায়ে হাঁটিয়েও তাদের নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাদের পাড়ি দিতে হয় পাহাড়, বন, সমুদ্র বা মরুভূমি৷ যানবাহনে ঝুলে ঝুলে যেতে হয়, যেতে হয় নৌকা বা জাহাজের খোলে লুকিয়ে৷

২০১৭ সালের এপ্রিলে এই টারজান ভিসায় নৌপথে ইটালির সীমান্তে পৌঁছতে পেরেছিলেন নেত্রকোনার রনি সাহা ও তার সহযাত্রীরা৷ কিন্তু তারপরও ভাগ্য তাদের প্রতি সদয় হয়নি৷ আটক হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছিল৷ তারপর ২০১৮ সালের মে মাসে আইওএম-এর সহায়তায় আবার দেশে ফিরে আসতে পারেন৷

রনি বলেন, ‘‘আমরা ১৫০ জনের মতো ছিলাম৷ আমাদের ইটালি পাঠানোর কথা ছিল৷ জাল ভিসায় আমাদের প্রথমে জর্ডান, জর্ডান থেকে মিশর, মিশর থেকে লিবিয়া পঠানো হয় বিমানে করে৷ লিবিয়ায় গিয়ে কিছুদিন আমরা চরম কষ্টে ছিলাম৷ এরপর প্লাস্টিকের নৌকায় করে আমাদের ইটালির সীমান্তে পাঠানো হয়৷ সেখানে আমারা আটক হই৷ ইটালি আর ঢুকতে পারিনি৷ এরপর আমরা তুরস্কে যাই৷ সেখানে আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়৷ তারপর আইওএম-এর সহায়তায় ২০১৮ সালের মে মাসে দেশে ফিরে আসি৷’’

আসলে ইমিগ্রেশনের একটি অসাধু চক্রের সহায়তায় আমাদের পাঠানো হয়েছিল ভেঙে ভেঙে: রনি সাহা

নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা রনি সাহা এই টারজান ভিসায় ইউরোপ যেতে দালালকে কয়েক দফায় ১২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন৷ কথা ছিল ইটালি নিয়ে তাদের চাকরি দেয়া হবে৷ তার পরিবার এই টাকা জোগাতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছে৷ এখন তিনি একটি মুদি দোকান চালায় তার এলাকায়৷ প্রতারক দালালদের চিনলেও মামলা করার সাহস করছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ভিসাই ছিল জাল৷ আসলে ইমিগ্রেশনের একটি অসাধু চক্রের সহায়তায় আমাদের পাঠানো হয়েছিল ভেঙে ভেঙে৷’’

সৌদি আরবসহ মধ্য প্রাচ্যের দেশে যাওয়ার জন্য আছে ফ্রি ভিসা৷ আর নৌপথে বোট বা জাহাজের খোলে লুকিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থার নাম দেয়া হয়েছে ডলফিন ভিসা৷ আসলে এর কোনোটাই কাজ পাওয়ার ভিসা নয়৷ এই ভিসা দিয়ে গিয়ে কোনো কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই৷ আটক হয়ে জেলে থাকতে হয় বা ফিরে আসতে হয়৷

ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘৯০-এর দশকে আমাদের দেশ থেকে লোকজন নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গল দিয়ে পাচার করা হতো৷ ২০১৫ সালে সমুদ্রপথে ডলফিন ভিসার নামে পাচার করা হতো৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ফ্রি ভিসার নামে মানব পাচার হয়েছে৷ এখনো বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ওমান, ইরাক, গ্রিস, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়ার বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচারের চেষ্টা হয়৷’’

ধারণা করা হয় বাংলাদেশের এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ১০ লাখের মতো আছেন, যারা এই টারজান, ডলফিন বা ফ্রি ভিসায় গিয়েছেন৷ তাদের অর্থ কোনোভাবেই বৈধ পথে বাংলাদেশে পাঠাতে পারেন না, কারণ, তারা নিজেরা ‘আনডকুমেন্টেড’৷ ধারণা করা হয় বৈধ পথে যে রেমিটেন্স আসে তার তুলনায় ৩০ ভাগ অর্থ আসে আনডকুমেন্টেড প্রবাসীদের কাছ থেকে৷ হুন্ডির মাধ্যমে আসে বলে তা রেমিটেন্সের ঘরে জমা হয় না৷

এই সময়ে যেসব দেশের নাগরিকরা সাগর পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ঢোকার চেষ্টা করে তারমধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ৷ ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন যুদ্ধের কারণে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে৷ কিন্তু তখন দেখা যায় তাদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন৷ তখন বাংলাদেশ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন ওঠে৷ ২০১৭ সালে ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি বাংলাদেশের আনডকুমেন্টেড নাগরিকদের ফেরত নিতে চাপ দেয়৷ তাদের ফেরত আনতে চুক্তি করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ৷ শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘আমরা যে উন্নয়নের কথা বলছি, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার কথা বলছি, তা কিন্তু মরিয়া হয়ে ইউরোপের দিকে ছুটে যাওয়া এই বাংলাদেশিরা প্রশ্নের মুখে ফেলছেন৷’’

এই করোনার সময় টারজান ভিসাচক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে জানান জনশক্তি রপ্তানি এবং অভিবাসন বিষয়ক বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন যেহেতু করোনার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ আছে, তাই মানবপাচার চক্র সুযোগ নিচ্ছে৷ এই চক্র বাংলাদেশ ও দুবাইসহ আরো অনেক দেশে এখন সক্রিয়৷’’

এরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন: বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখানে আসলে কোনো ভিসা থাকে না৷ জাল ভিসা বা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত বভিন্ন দেশের ভিসা ব্যবহার করা হয়৷ যারা পৌঁছাতে পারেন তাদেরও নানা কৌশলে ওইসব দেশে থাকতে হয় বা কাজ করতে হয়৷ যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকায় এইভাবে যাওয়া এক তরুণ জানান, তিনি সেখানে অর্থের বিনিময়ে ওই দেশের এক নারীকে চুক্তিতে বিয়ে করে সেখানে থাকছেন৷ যদিও ওই নারীকে তিনি কখনো দেখেননি বা দেখবেন না৷’’

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, নানাভাবে সচেতন করার পরও এক শ্রেণির মানুষ জেনেশুনেই জাল ভিসায় উন্নত জীবনের লোভে অনেক টাকা খরচ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ বিএমইটি-র মাধ্যমে ওই ধরনের ভিসায় আদৌ চাকরি আছে কিনা তা যাচাই করার সুযোগ আছে৷ কিন্তু তারা তা করছেন না৷ তারা জেনেশুনেই ঝুঁকি নিচ্ছেন৷ বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বলেন, ‘‘কেউ যখন বিপদে পড়েন তখন তাদের কথা আমরা জানতে পারি৷ কিন্তু যারা কৌশলে যেতে পারেন এবং গিয়ে টিকে যান তাদের কথা তো আমরা জানতে পারছি না৷ এরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন৷’’

তার মতে, এর পিছনে দেশি-বিদেশি মানব পাচার চক্র ও ইমিগ্রেশনের এক শ্রেণির সদস্য জড়িত৷ তা না হলে তারা জাল ভিসা নিয়ে বিমানে ওঠেন কিভাবে? যারা এই প্রতারণার শিকার হন তারা যদি সবাই মানব পাচার আইনে মামলা করেন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি আরো সাক্রিয় হয় তাহলে হয়ত  এই প্রবণতা কমবে৷

এটা নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন৷ এই মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে বলে জানান তিনি৷

পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ ছাড়া ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের তেমন কোনো সুযোগ নেই বলে জানান শামছুল আলম৷ প্রতারণা থেকে রেহাই পেতে সবাইকে তিনি তাদের ভিসা এবং ভিসার বিপরীতে চাকরি আছে কিনা তা যাচাই করে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য