জৈব জ্বালানি এবং খাদ্য সংকট - একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ
২৯ জুন ২০১২জৈব জ্বালানি নিয়ে এতোদিন পর্যন্ত শুধু ইতিবাচক কথা শোনা গেলেও এখন জানা গেছে এর ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কার কথা৷ তবুও সমাজে জৈব জ্বালানির নেতিবাচক প্রভাবের মতো উদ্বেগের বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ তাই ইইউ নীতি নির্ধারকদের এ ব্যাপারে সাবধান করে দিতে গুয়াতেমালায় খাদ্য সংকটের শিকার ব্যক্তিরা গত সপ্তাহে ব্রাসেলসে হাজির হয়েছিলেন৷
আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড যোগ হওয়ার মাত্রা হ্রাসে গত প্রায় তিন বছর আগে বিভিন্ন পরিবহণে অধিক হারে জৈব জ্বালানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ ২০০৯ সালে গৃহীত এই উদ্যোগের লক্ষ্য, ২০২০ সাল নাগাদ পরিবহণে ব্যবহৃত পেট্রোল ও ডিজেলের সাথে ১০ শতাংশ জৈব জ্বালানি সংযোজন৷ কিন্তু এই উদ্যোগ গ্রহণের আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলো জৈব জ্বালানির ফলে একাধিক ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে৷
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড-এর হিসাবে, ইউরোপের ঐ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অন্তত ৬৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার জমিকে শস্য ক্ষেতে রূপান্তরিত করতে হবে, যা বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস এর আয়তনের যোগফলের চেয়েও বেশি৷ উপরন্তু এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, তৃণভূমি এবং জলাভূমিকে শস্য ক্ষেতে পরিণত করতে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টন অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে৷ যা বর্তমান ধারায় জ্বালানি ব্যবহার করে ইউরোপের রাস্তায় চলাচলকারী গাড়িগুলোর চেয়ে প্রায় দেড় থেকে আড়াই কোটি বেশি গাড়ি ২০২০ সাল নাগাদ সময়ের মধ্যে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত করবে তার সমান৷
সংস্থাটি আরো বলছে, ইইউ অঞ্চলে তাদের লক্ষিত মাত্রায় অতিরিক্ত জৈব জ্বালানি যোগ হলে, সেটি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের চেয়ে ৮১ থেকে ১৬৭ শতাংশ বেশি হারে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করবে৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর হিসাবে, ইইউ এর পরিকল্পনা অনুসারে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে এর ফলে তেলবীজ, ভুট্টা এবং চিনির দাম বেড়ে যাবে৷ অস্ট্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড সিস্টেমস অ্যানালাইসিস - ইয়াসা'র এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, ইইউ এর পরিকল্পনা মাফিক জৈব জ্বালানির ব্যবহার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলে এর ফলে অতিরিক্ত ১৪ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে৷ পরিণামে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শহরে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষ, কৃষিজীবী এবং ভূমিহীনরা৷
এছাড়া রোম ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন জানিয়েছে, জৈব জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বজুড়ে ৫০ শতাংশরও বেশি হারে জমি অধিগ্রহণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এসব ক্ষতিকর প্রভাবের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন সংস্থা ইইউ নীতি নির্ধারকদের জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ বাতিলের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও ইইউ নতুন করে ২০৩০ সালের জন্যও প্রায় একই ধরণের উদ্যোগের কথা ভাবছে বলে জানা গেছে৷
উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম এর বিশেষজ্ঞ মার্ক অলিভিয়ের হেরম্যান বার্তা সংস্থা আইপিএস'কে বলেছেন, ‘‘২০২০ সাল পরবর্তী ইউরোপের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবেশের একপাক্ষিক লাভের কথা বিবেচনা করা হলেও এর ফলে জৈব জ্বালানির সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি আদৌ স্থান পায়নি৷'' এমনকি চলতি মাসে প্রকাশিত ইইউ'র ২০২০ সাল পরবর্তী যোগাযোগ পরিকল্পনায় খাদ্য নিরাপত্তা তো দূরের কথা শুধুমাত্র ‘খাদ্য' শব্দটিও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন হেরম্যান৷ তাঁর মতে, ইইউ জৈব জ্বালানির ব্যবহার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদার কথা ভেবে প্রচণ্ড তাড়াহুড়ো করছে৷ বিশেষ করে জৈব জ্বালানি খাতে বিনিয়োগকারীদের লাভের নিশ্চয়তার ব্যাপারটিই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি৷
ইউরোপীয় নীতি নির্ধারকরা জৈব জ্বালানির সামাজিক ক্ষতির বিষয়টি উপেক্ষা করলেও তাদের পদক্ষেপের ফল ইতিমধ্যে মানুষের জীবন-যাত্রায় দুর্ভোগ ও সংকট যোগ করেছে৷ বিশেষ করে গুয়াতেমালার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক মানুষ এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয়েছে৷ জৈব জ্বালানি উৎপাদনে ব্যাপকহারে পাম-তেল ও ইক্ষুর জমি তৈরি করতে ভূমি অধিগ্রহণ, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং পানি প্রবাহের গতি পরিবর্তন করা হচ্ছে৷ ফলশ্রুতিতে গুয়াতেমালার আদিবাসীরা খাদ্য সংকটসহ নানামুখী দুর্ভোগের মুখে পড়ছে৷ তাই এসব দুর্ভোগ পীড়িত মানুষ জৈব জ্বালানির ব্যাপারে ইইউ নেতাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে৷
এএইচ / জেডএইচ (আইপিএস)