স্বেচ্ছাসেবীদের ঐতিহ্য
২৩ আগস্ট ২০১৩কারা এই সব ভলান্টিয়ার? তাঁরা করেনই বা কি? ধরুন জার্মান রেড ক্রসের মতো কোনো ত্রাণ সংগঠনে প্যারামেডিক হিসেবে কাজ করেন৷ কিংবা স্থানীয় ফুটবল ক্লাবে ছোটদের ফুটবলের ট্রেনিং দেন৷ সারা জার্মানিতে প্রায় তিন কেটি মানুষ এভাবে স্বেচ্ছাসেবী বা ভলান্টিয়ার হয়ে কাজ করেন: মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ৷
খ্রিষ্টীয় প্রথা থেকে সূচনা
দীনদরিদ্রের সেবা করার প্রথাটা খ্রিষ্টধর্মের অঙ্গ৷ কিন্তু ১৭৮৮ সাল পর্যন্ত যে যার নিজের মতো ও ইচ্ছে অনুযায়ী দরিদ্রের সেবা করত৷ জার্মানিতে সংগঠিতভাবে দরিদ্রের সেবা শুরু হয় ঠিক ঐ সালে, স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে৷ হামবুর্গের ব্যবসায়ী কাস্পার ফোগ্ট দরিদ্রদের জন্য একটি আবাস প্রতিষ্ঠা করেন৷ দরিদ্রদের সাহায্য করাটা গোটা সমাজের কর্তব্য বলে মনে করতেন ফোগ্ট৷
ফোগ্টের বিশাল সংগঠনে মোট ২০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতেন: তাঁদের মধ্যে সেনেট এবং পৌরসভার সদস্য থেকে শুরু করে চিকিৎসক, শিক্ষক, সবাই ছিলেন৷ হামবুর্গের বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতেন তাঁরা৷ স্বেচ্ছাসেবীদের এই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা সরকারি কর্মসূচিকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলবে: সেই ধারণা থেকেই আজকের ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট'-এর জন্ম৷
রাজনীতির মেজাজ-মর্জি
১৮০৬ সাল৷ নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী তখন সবে প্রাশিয়া জয় করেছে৷ প্রশিয়ার রাজা তৃতীয় ফ্রিডরিশ উইলহেল্ম তাঁর কেটে-ছেঁটে ছোট হয়ে যাওয়া, দুর্বল রাজ্যটাকে স্থিতি দিতে ব্যস্ত৷ সরকারের খরচ বাঁচাতে তিনি ধনি, সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের পৌর প্রশাসনে অবৈতনিক চাকরি নিতে বাধ্য করেন৷ প্রাশিয়ায় পৌর প্রশাসন সংক্রান্ত অনুশাসনে ১৮০৮ সালে কথাটি প্রথম দেখতে পাওয়া যায়: ‘এহরেনআম্ট', সাম্মানিক দপ্তর কিংবা চাকুরি৷
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি জার্মানিতে ‘ভেরাইন' বা সমিতির সংখ্যা বাড়তে থাকে: জনকল্যাণ সমিতি, খেলাধুলার সমিতি, মহিলা সমিতি, শ্রমিক সমিতি – যে কারণে জার্মানিতে তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে এই সংঘবদ্ধ সমিতি কালচারের একটা বিশেষ যোগ আছে৷ তবে এহরেনআম্টের বিপর্যয় ডেকে আনে নাৎসি অপশাসন৷ নাৎসিরা যখন ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসে, তখন তারা সমিতি ও ক্লাবগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলির মতোই বাতিল করে দেয়৷
নাৎসি আমলে শুধুমাত্র রণাঙ্গণে সৈন্যদের কল্যাণের জন্য – এবং কিছুটা দরিদ্রদের জন্য দান করার উপায় ছিল৷ কিন্তু তথাকথিত ‘শীতকালীন ত্রাণ কর্মসূচির' জন্য যারা চাঁদা তুলতে বেরতো, তাদের ঠিক ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবী বলা চলে না৷ ভলান্টিয়ার হতে, কিংবা চাঁদা দিতে অস্বীকার করার বিপদ ছিল৷ ক্ষেত্রবিশেষে অর্থদণ্ড এমনকি কারাদণ্ড দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশকে আবার সেই সব পুরনো সমিতির দর্শন পাওয়া যায়, ভলান্টিয়ারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চাঁদা তুলতে দেখা যায়৷ কিন্তু নাৎসি আমলের অভিজ্ঞতার পর জার্মানরা আজও চাঁদা তোলার এই পন্থা – কিংবা অন্য কোনোরকম পন্থা সম্পর্কে সন্দিহান৷ তাই সমিতির হয়ে চাঁদা তোলার কাজটা প্রয়োজনীয় হলেও, আজও সমাজে তার বিশেষ স্বীকৃতি নেই৷
এহেরেনআম্ট জিন্দাবাদ!
কিন্তু এহরেনআম্ট তার হৃত ‘এহরে', মানে ‘সম্মান' আবার ফিরে পেয়েছে: খেলাধুলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি, গির্জা কিংবা সমাজকল্যাণ, আর সেইসঙ্গে ভলান্টিয়ার ফায়ার ব্রিগেড, সর্বত্রই স্বেচ্ছাসোবীদের দেখতে পাওয়া যাবে৷ এমনকি আশির দশকে জার্মান শান্তি আন্দোলন কিংবা পরিবেশ আন্দোলনও এই স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে৷
আর আজ? একবিংশ শতাব্দী মানে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ৷ এ যুগে সমিতির জায়গা নিতে চলেছে ভলান্টিয়ার এজেন্সি৷ আজ আর মানুষের সময় নেই, সারা জীবনের উদ্যোগের পরিবর্তে আজ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কোনো প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট হওয়াটাই হলো ‘ট্রেন্ড' কিংবা প্রবণতা৷ কিন্তু ইন্টারনেট যেমন মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগের বিকল্প হতে পারে না, তেমনই এহরেনআম্ট আজও জার্মান সমাজে তার ভূমিকা পালন করে চলেছে৷