জার্মানিতে বিচারকেরা স্বাধীন, তবে...
১৯ নভেম্বর ২০২১জার্মানিতে জেলা বা রাজ্য আদালতগুলোতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ক'দিন আগে এক বিচারকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম৷ তিনি যা জানালেন তাতে প্রক্রিয়াটি এরকম৷
সাধারণত একজন বিচারক হতে চাইলে তাকে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে হবে৷ খেয়াল রাখতে হবে নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষায় তিনি যেনো বেশ ভালো নম্বর পান৷ তাকে ‘ক্লার্কশিপ’ করতে হবে৷ এরপর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা যায়৷ একজন ব্যক্তির তিন থেকে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বিবেচনা করা হয় তাকে শুরুতেই স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে নাকি তিনি আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পাবেন৷
আমাকে তথ্য দেয়া বিচারকের বিস্তারিত পরিচয় জানানো যাচ্ছে না গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে৷ জার্মান আইনের বিস্তারিত নানা দিক সরকারি বিভিন্ন ওয়েবসাইটেই রয়েছে৷ সেগুলো ঘাঁটাঘাটি করলে বিষয়টি নিয়ে আরো ধারণা পাওয়া যায়৷
জার্মানির সংবিধান, যেটি ‘বেসিক ল’ হিসেবে পরিচিত, সেখানে একজন বিচারক শুধুমাত্র সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ এবং রায় প্রদানের ক্ষেত্রে তাকে অন্য কেউ প্রভাবিত করতে পারবে না বলে উল্লেখ রয়েছে৷
একজন বিচারক যেখানে কাজ শুরু করেন, পুরোটা সময় সেখানেই কাজ করবেন বলেও নিয়ম রয়েছে৷
আপাতদৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়া পানির মতো স্বচ্ছ মনে হলেও আসলে পুরোপুরি নিঁখুত বলে কিছু নেই৷ যেমন ‘বেসিক ল’-তে যা উল্লেখ আছে তার ব্যাখ্যা একেকজন একেক রকম দিতে পারেন৷ বিচারকদের সেরকম কোনো ব্যাখ্যা যদি প্রকৃতঅর্থে সংগতিপূর্ণ মনে না হয় কিংবা যদি মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করছেন সেক্ষেত্রে করণীয় কী?
বিচারকদের জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য জার্মানির বিচার বিভাগের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কাঠামো রয়েছে৷ সেখানে একজন রাজ্য পর্যায়ের বিচারকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করা হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হয়৷ কাঠামোটি এমন যে তাতে বাইরের কোনো পক্ষের অর্থাৎ আইনপ্রণেতাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই৷
বরং যে বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি যাতে সুবিচার পান তা নিশ্চিত করা হয় বিভিন্ন ধাপে৷ বিষয়টি জার্মানির সর্বোচ্চ আদালত, যেটিকে সাংবিধানিক আদালত বলা হয়, সেখানেও গড়াতে পারে৷ সাংবিধানিক আদালত শুধুমাত্র সংবিধানের আলোকে রায় দিয়ে থাকে৷
সেই আদালতের রায়ও যদি কারো পছন্দ না হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিচার আদালত এবং মানবাধিকার আদালতেও বিষয়টি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ জার্মানি যেহেতু ইইউর সদস্য, তাই এই দুই আদালত চাইলে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের রায় রিভিউ করতে পারে এবং সেই রায় বাতিলও করতে পারে৷
আইনপ্রণেতাদের কি তাহলে কোনো প্রভাব নেই?
মোটা দাগে জার্মানির বিচার বিভাগ নিজস্ব বিষয়াদি নিজেরাই সুরাহা করতে সক্ষম, এক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই৷ তবে, ইউরোপের শক্তিশালী গণতন্ত্রের এই দেশটি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন সর্বত্র ঘটাতে চায়৷ তাই বিচারক নিয়োগের দু'টি পর্যায়ে সুনির্দিষ্টভাবে আইনপ্রণেতা, অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধিদের অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে৷
প্রথমত, রাজ্যপর্যায়ে বিচারকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে জুডিশিয়ারি কাউন্সিল৷ এই কাউন্সিলগুলো নির্ধারণ করে কাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে কিংবা কাকে পদোন্নতি দেয়া হবে৷ অধিকাংশ কাউন্সিলে সদস্যদের মধ্যে রাজ্য সংসদের সাংসদরা রয়েছেন৷ অর্থাৎ তারা একজন বিচারকের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারেন৷
দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে প্রধান বিচারপতি বলে কেউ নেই, বরং জার্মানির সর্বোচ্চ আদালত সাংবিধানিক আদালতের বাইরে আরো পাঁচটি কেন্দ্রীয় আদালত রয়েছে যেগুলো সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের বিচার করে৷ এসব আদালতের বিচারক নির্বাচিত হয় ৩২ সদস্যের কমিটির মধ্যে গোপন ভোটাভুটির মাধ্যমে৷ এই ৩২ সদস্যের মধ্যে ১৬ জন হচ্ছেন ১৬টি রাজ্যের বিচারমন্ত্রী এবং অন্য ১৬ জন জার্মান সংসদ বুন্ডেসটাগের নির্ধারিত প্রতিনিধি৷ এই প্রতিনিধিরা আইনপ্রণেতা নাও হতে পারেন তবে তাদের আইন বিশেষজ্ঞ হতে হবে৷
সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক
সাংবিধানিক আদালতের বিচারক করা হবেন তা গোপনে নির্ধারণ করেন ১২ জন সংসদ সদস্যের এক কমিটি৷ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের এই প্রক্রিয়া নিয়ে জার্মানিতে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে৷ দেশটির আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক কিনা তা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো করা হয়নি৷
দেখা যায় এই প্রক্রিয়ায় জার্মানির সংসদে সব থেকে বেশি প্রতিনিধিত্ব থাকা বড় দলগুলো জার্মানির সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারছে৷ কখনো কখনো সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সমর্থনের অভাবে সব বিবেচনায় ভালো বিচারকরাও সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগ পান না৷
অর্থাৎ বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতারা ভালোই ভুমিকা রাখতে পারেন৷ কিন্তু নিয়োগের পর বিচারকের স্বাধীনতায় যাতে তাদের হস্তক্ষেপ না থাকে সেজন্য আরো একটি স্তর রয়েছে জার্মানিতে৷
সর্বোচ্চ আদালতে একজন বিচারককে ১২ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়৷ আর জার্মান সংসদের মেয়াদ হয় চার বছরের৷ তাই সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিচারক বদলানো যায় না৷ আর একজন বিচারকের অভিশংসন সংসদের পক্ষে করা দৃশ্যত সম্ভব হলেও কার্যত প্রায় অসম্ভব৷