জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি স্পষ্ট বাংলাদেশে
২ ডিসেম্বর ২০১১মোসাম্মাত মনোয়ারা প্রতি দুদিন পরপর তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে যান খাবার পানি আনতে৷ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ৷ অন্তত দুই থেকে তিন কলসি পানি তাঁকে আনতে হয়৷ তবে তিনি একা নন৷ তাঁর সঙ্গে আশেপাশের বাড়ির আরো অনেক মহিলা রয়েছেন৷ রাজশাহী জেলার শারমঙ্গোলিয়া গ্রামে পানির অভাব অনেকদিন থেকেই দেখা যাচ্ছে৷ গত এক দশক ধরে মনোয়ারা এভাবেই পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করছে৷ এর কারণ হল তাদের এলাকার টিউবওয়েলগুলো শুকিয়ে গেছে৷
ঢাকার প্রেস ক্লাবে তিনি এসেছিলেন এই সমস্যা তুলে ধরতে৷ অক্টোবর মাসে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে একটি ট্রাইবুনালের শুনানি হয়৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন মোসাম্মত মনোয়ারা৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশনের মত করে আমাদের পানি ব্যবহার করতে হয়৷ সপ্তাহে একদিন আমরা গোসল করি৷ রান্নাও করতে হয় খুব অল্প পরিমাণে কারণ ধোয়া-ধুয়ির জন্য পানি থাকে না৷''
‘‘আমরা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি'' – রুবিনা আখতার
একই কথা জানালেন ২৫ বছর বয়সি রুবিনা আখতার৷ রংপুর জেলার চর মরনিয়া গ্রামের বাসিন্দা রুবিনা৷ তিনি জানান,‘‘তিস্তা নদির ভাঙনে আমি আমার ঘর-বাড়ি হারিয়েছি৷ গত পাঁচ বছরে চারবার এই ঘটনা ঘটেছে৷ গত বর্ষায় আমরা নদী থেকে অনেক দূরে ঘর তৈরি করেছিলাম কিন্তু বন্যা সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷ আমাদের মাছ ধরার নৌকা পর্যন্ত৷ আমরা এখন খোলা আকাশের নীচে থাকি৷ দয়া করে কেউ যদি কিছু খেতে দেয় তখন আমরা কিছু খাই নয়তো না খেয়ে থাকি৷''
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একজন মহিলা জানান, ‘‘আমি পাঁচ বছরে তিনটি বন্যা দেখেছি৷ আমরা এখন বন্যার সঙ্গে বসবাস শুরু করেছি৷ এই পানি গায়ে লাগার ফলে বিভিন্ন ধরণের চুলকানিও দেখা দিয়েছে৷''
যে কোন সময়ে যে কোন ধরণের মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারে
আবু মোস্তফা কামাল পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন৷ তিনি জানান, আবহাওয়া এবং জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে উপকূলের প্রায় তিন কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হবে৷ এর পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষিকাজও নানাভাবে ব্যাহত হবে৷ তিনি বলেন,‘‘আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক৷ এর ফলে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা বেড়েছে এবং বাড়ছে সমুদ্রের পানিও৷ পানিতে নোনাভাব বেশি, গাছ গাছালি মরে যাচ্ছে – বিশুদ্ধ পানির অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি শহরেই৷ সবচেয়ে বড় ভয় হল এসবের ফলে যেকোন সময়ে যেকোন ধরণের মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ আমরা কৃষিনির্ভর দেশ – আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে এই ক্ষেত্রে৷ প্রচণ্ড চাপ পড়ছে পরিকাঠামোর ওপর৷''
একশো কোটি ডলার নিয়ে তর্ক এবং বিতর্ক
গত বছর কানকুনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সব দেশ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে তাদের সাহায্য করতে একশো কোটি ডলার বরাদ্দ করা হবে৷ সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে৷ বরাদ্দ করা এই অর্থ দিয়ে ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষদের সাহায্য করা হবে৷ তবে কীভাবে এই অর্থ ব্যয় করা হবে তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে বিতর্ক৷ এই অর্থ নিয়ন্ত্রণ করবে কে? ঠিক কোন কোন খাতে অর্থ বরাদ্দ করা হবে? এসব প্রশ্ন নিয়েই আলোচনা করা হচ্ছে ডারবানে৷ বাংলাদেশের বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ জানান, অতি দ্রুত এই অর্থ বাংলাদেশের প্রয়োজন৷ হাসান মাহমুদ জানান,‘‘আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের মানিয়ে চলতে হবে৷ এবং এর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমরা নদীর ভাঙন বন্ধ করতে নদীর পার বাঁধাই করতে পারি, নদীর তলায় খনন করতে পারি – এসবের ফলে নদীকে আরো নানাভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারবো৷ বন্যা রোধ করা সম্ভব হবে৷ আর তা হলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে আর গৃহহীন হতে হবে না৷''
ড. হাসান মাহমুদ বলেন, শুধু বাংলাদেশের সমস্যা মেটাতেই প্রয়োজন অন্তত দশ কোটি ডলার এবং তা প্রয়োজন আগামী তিন-চার বছরের মধ্যেই৷ কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক