1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সারোগেসিকে কি বৈধতা দেয়া উচিত?

৩০ অক্টোবর ২০১৭

‘সারোগেসি’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই৷ কিন্তু এমন জটিল বিষয়কে মঞ্চে উপস্থাপন করা সাহসের ব্যাপার বৈকি! আর সেই সাহসটি দেখিয়েছেন জার্মান পরিচালক সোফিয়া স্টেপ্ফ৷ তাঁর ‘গ্লোবাল বেলি’ আপনাকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবেই৷

https://p.dw.com/p/2mkn0
ছবি: Debarati Guha

বাংলাদেশে থাকতে থিয়েটারে নাটক দেখা ছিল একটা নেশা৷ সেই নেশা এক পর্যায়ে আসক্তিতে পরিণত হয়েছিল৷ বাংলাদেশে যাঁরা ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, প্রাচ্য নাট, নাগরিক – এ সব নাট্যদলের নাটক দেখেছেন, তাঁরা জানেন, বড় একটা বিষয়কে অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কী দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তোলেন৷ টিভির চেয়ে মঞ্চ আমার কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয়, কারণ, এক্ষেত্রে দর্শক আর অভিনেতার মধ্যে যোগাযোগটা হয় সরাসরি৷

আর এ কারণেই ‘গ্লোবাল বেলি’ নাটকটি দেখার আমন্ত্রণ পেয়ে তা লুফে নিয়েছিলাম৷ একে তো নাটকটি জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায়, তার ওপর নাটকটির অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করছেন আমাদের খুব কাছের একজন মানুষ৷ নাটকটি সম্পর্কে আগে থেকেই কিছুটা আভাস পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকেই৷ গবেষণার পুরো ব্যাপারটি জানা ছিল৷ কিন্তু যা দেখলাম, তার সঙ্গে আগের ভাবনাটা ঠিক মেলানো গেল না৷

Theater Global Belly
‘গ্লোবাল বেলি’-র চারজন মূল অভিনেতা-অভিনেত্রীছবি: Debarati Guha

না, এটা ঠিক নেতিবাচক অর্থে বলছি না৷ পুরোটা বললে হয়ত বুঝতে পারবেন৷ এবারের নাটকটার মঞ্চায়ন হয়েছিল মধ্য জার্মানির শহর কাসেলে৷ নাটকটির ভিন্নতার কারণে ৩০ জনের বেশি দর্শককের স্থান হয়নি সেখানে৷ আর সেই ৩০ জনের মধ্যে আমি আর আমার দুই বান্ধবী ভাগ্যবান৷ নির্দিষ্ট সময়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম৷ ভেতরে ঢুকতেই বিস্ময় – কোথায় মঞ্চ, কোথায় বা আসন! চারপাশে চারটি বড় বড় ‘স্ক্রিন’ লাগানো রয়েছে কাঠের ফ্রেমে৷ ফাঁকে ফাঁকে ছয় জন করে বসার জায়গা৷ মাঝে একটি ল্যাপটপ, একটি টেবিল৷ ব্যাস!

নাটকের শুরুটা হয় কথা ও গানের সংমিশ্রণে৷ যেখানে ‘‘আমার ডিম্বাণু নেই, আমার শুক্রাণু নেই, আমার ‘সিস্ট’ হয়েছে, আমি অনেকবার অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিয়ে গেছি, আমি সমকামী’’ – এমন নানা ধরনের মানুষের কথা বলা হতে থাকে৷ বলা হয় যাঁরা সন্তান চান, কিন্তু দত্তক, আইভিএফ বা অন্য কোনো উপায়ে সন্তান নিতে পারছেন না, তাঁদের কথা৷ প্রশ্ন রাখা হয়, তারা কি তবে গর্ভ ভাড়া করতে পারেন? এরপর সারোগেসি কী, কোথায় বেশি সারোগেসি হয়, কত অর্থ লাগে, এর প্রক্রিয়াটিই বা কী – গোটা ব্যাপারটা গান এবং কথার মাধ্যমে জানানো হয়৷

পুরো নাটকে চারটি মুখ্য চরিত্র – ভারতীয় এক ডাক্তার, মার্কিন এক সারোগেট মা, ইউক্রেনের জার্মান দূতাবাসে কর্মরত এক কর্মী এবং জার্মান এক সমকামী৷ এছাড়া রয়েছে একটি ভিডিও ইন্সটলেশন, যাতে ক্রিস্টাল ট্রাভিস নামের এক আন্তর্জাতিক দালালের গল্প শুনতে পারবেন আপনি৷ এর বাইরেও কিন্তু আরো অনেক চরিত্র আছে৷ আর সেইসব চরিত্রে অভিনয় করতে হয় দর্শককে! মুখ্য চারটি চরিত্র একেকবারে সেই ছয় জন ছয় জন করে বসে থাকা দর্শকদের দল নিয়ে নিজ নিজ স্ক্রিনের পিছনে চলে যান৷ সেখানে দর্শকদের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র দেয়া হয়৷ কেউ সারোগেট মা, কেউ সন্তান চান এমন দম্পতি, কেউ বা পরিবারের সদস্য তো কেউ৷ ইউক্রেনের জার্মান রাষ্ট্রদূতের সেই কর্মী যেমন দু' জন দর্শককে সারোগেট মা এবং বাকি চারজনকে জার্মানি থেকে যাওয়া দুই দম্পতি হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ ধরে নেওয়া হয়, তাঁরা জার্মানিতে সারোগেসি অবৈধ হওয়ার কারণে ইউক্রেনে গেছেন৷ এভাবে একটি ‘সিচুয়েশন' বা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইউক্রেনে সারোগেসির চিত্রটা তুলে ধরেন অভিনেতা৷

৯ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আবার পরের অভিনেতার কাছে যেতে হয় দর্শকদের৷ ধরুন, আপনি যদি ইউক্রেনের জার্মান দূতাবাসের কর্মী দিয়ে শুরু করেন, তাহলে প্রথমে ভিডিও সাক্ষাৎকার, তারপর এক এক করে জার্মান সমকামীর ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন, তাঁর বাড়ি যেতে হবে৷ তারপর যেতে হবে সোজা ভারতের আনন্দ শহরের এক চিকিৎসকের কাছে৷ এরপর আপনি যাবেন একজন মার্কিন সারোগেট মায়ের কাছে, যিনি দর্শকদের মধ্যে থেকে বেছে নেবেন তাঁর স্বামী-সন্তান, এমনকি জার্মানি থেকে আসা এক সন্তানহীন দম্পতিকেও৷ এভাবে চার অভিনেতার চার দেওয়ালের পিছনে আপনিও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে করতে সারোগেসি ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাবেন৷ এক-একটা পরিস্থিতি আপনাকে এক-একটি দেশের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে৷

সব শুনে যখন আপনার মনে হচ্ছে সারোগেসির মাধ্যমে একজন নিঃসন্তান মা বা বাবা সন্তান লাভ করতেই পারেন, ঠিক তখনই আপনার সামনে হাজির হবেন তিন জন নারীবাদী৷ তাঁদের মধ্যে তর্ক হবে গান ও কথার মাধ্যমে৷ প্রশ্ন উঠবে, দরিদ্র নারীরাই কেন কেবল সারোগেট মা হন, ধনীরা কেন নন? যাঁরা নিজেদের নারীবাদী বলছেন, যাঁরা বলছেন চাইলেই আমি আমার শরীরকে যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারি, তাঁদের কাছে প্রশ্ন তোলা হবে – তাহলে কেন তুমি অন্য কারো সন্তান ধারণ করছো না? দর্শকের মনেও তখন উঠতে থাকে নানা প্রশ্ন: তাহলে কি সারোগেসি পূঁজিবাদকেই উসকে দেয়? দরিদ্র মায়ের গর্ভকে ব্যবহার করা হয় শুধু অর্থের বিনিময়ে?

পুরো নাটকের মধ্যে সেই চার অভিনেতা বা সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে যখন দর্শকের কথোপকথন হয়, তখন আপনি চাইলে তাঁদের প্রশ্নও করতে পারেন৷ যেমন যিনি যুক্তরাষ্ট্রবাসী সারোগেট মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর কাছে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘‘শিশুটি যদি বিকলাঙ্গ বা জিনগত কোনো সমস্যায় ভুগতো, তাহলে কি আপনি সেই সন্তান গ্রহণ করতেন?'' সত্যিই তো, আপনার মনেও কি এমন প্রশ্ন আসে না! কিন্তু অন্য কোনো মঞ্চ নাটকে সেই প্রশ্ন করার সুযোগ কি পান আপনি? এখানেই নাটকটির ভিন্নতা৷

পুরো নাটকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সন্তানহীনদের সন্তান পাওয়ার আকুতি বা আকাঙ্খা৷ কিন্তু পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে এ সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোর কথাও৷ তাই জার্মানি বা অন্য দেশে সারোগেসি বৈধ করা উচিত কিনা – সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে দর্শকের কাছেই৷ দর্শকই ভাবুক, যোগ-বিয়োগ করে হিসেব মেলাক কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত৷

অমৃতা পারভেজ
অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen

লেয়া হুইচার, সোনাটা (দেবারতি গুহ), আনে হফমান এবং মাটিয়াস রেঙার – প্রত্যেকেই নিজস্ব চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন৷ তবে দু'জনের কথা না বললেই নয়৷ তাঁরা হলেন লেয়া এবং সোনাটা৷ এই দুই অভিনেত্রী একইসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেছেন, গান গেয়েছেন, চোখের পলকে বদল ঘটেছে তাঁদের চরিত্রের৷ অথচ দর্শকের কাছে মনে হয়নি যে সেটা আরোপিত৷ দর্শকের সাথে চোখে চোখ রেখে তাঁরা যে অনবদ্য যোগসূত্র রচনা করেছেন, তা আসলেই দুর্দান্ত৷

গানগুলোর কথাও আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে৷ পুরো নাটকটির পেছনে যে বিস্তর গবেষণা রয়েছে, তা আপনি নাটকটি দেখলেই উপলব্ধি করতে পারবেন৷ এ কথা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়৷ সবশেষে এটাই বলতে চাই, সমাজের এমন নানা বিষয় নিয়ে এ ধরনের নাটক হোক বাংলাদেশেও৷ এটা আসলে অনেকটা থেরাপির মতো, যার মধ্যে দিয়ে আপনার মনের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন৷ আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবেই এ নাটক৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অমৃতা পারভেজ৷
অমৃতা পারভেজ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷