‘গ্রামের জীবন – গ্রামের মাঝে জীবন’
২৫ নভেম্বর ২০১২নাম স্ভেন লাখমান৷ পেশায় আঞ্চলিক ম্যানেজার৷ তাঁর কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই৷ জার্মানির রাইনল্যান্ড প্যালেটিনেট রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ান৷ কখনো দরজায় বেল বাজিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন৷ কখনো বা গ্রামের উন্নয়নের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের সামনে ভাষণ দেন৷ নানা বিরোধের নিষ্পত্তি করারও চেষ্টা করেন৷ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরাও তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে৷
স্ভেন লাখমান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ্য করছেন, কীভাবে গ্রামের জনসংখ্যার মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তরুণ-তরুণীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে৷ এই প্রবণতা থামানো যাচ্ছে না, বললেন তিনি৷ তবে লাখমান সমস্যাটির গভীরে যাবার চেষ্টা করেছেন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘অনেক এলাকায় আমরা সমীক্ষা চালিয়েছি৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, যে বয়স্ক মানুষেরা নিজেদের পরিচিত পরিবেশে বসবাস করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন৷ তবে তার মানে এই নয় যে নিজের বসতবাড়ি বা নিজের গ্রামকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে৷ পাশের গ্রাম হলেও তাঁদের আপত্তি নেই৷ কিন্তু এর থেকে বেশি দূরে যেতে চান না অনেকেই৷''
বয়স্কদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে স্ভেন লাখমান বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে শুধু জ্বালানি সাশ্রয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘরের মধ্যে চলাফেরার পথে বাধা দূর করার পক্ষেও সওয়াল করেন৷ তাঁর মতে, অশীতিপর মানুষের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি৷ কিন্তু গ্রামাঞ্চলের পরিষদগুলির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করা কঠিন৷ সরকারি অনুদান পাওয়ার আশাও কম৷ তাই শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে আকর্ষণ করতে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ এলাকা ‘কমার্শিয়াল এরিয়া' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে৷ সেখানে বড় বড় দোকান, গুদাম বা দপ্তর গড়ে উঠছে৷ এর ফলে কর বাবদ আয় বাড়ছে গ্রামের প্রশাসনিক পরিষদের৷ কিন্তু গ্রামগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে এত বেশি জায়গা ‘কমার্শিয়াল এরিয়া' হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় বেশি৷ শিল্প সংস্থাগুলিকে আকর্ষণ করতে যে সব ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন স্ভেন লাখমান৷
ঠিক এই ধরণের বিপদ এড়াতেই গ্রামাঞ্চলের পরিষদগুলি স্ভেন লাখমান-এর সহায়তা নিতে পারে৷ ভেস্টারভাল্ড এলাকায় তিনি ২১টি গ্রামের একটি অঞ্চলের প্রকল্পকে এ ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরছেন৷ অন্য অনেক অঞ্চলের মতো এখানেও অনেকে গ্রামের কেন্দ্রস্থল ছেড়ে বাইরের দিকে ‘কমার্শিয়াল এরিয়া'-য় গিয়ে সস্তায় বাড়িঘর নির্মাণ করেছিল৷ এর ফলে মূল গ্রামগুলি অবহেলিত হতে থাকে৷ ২০০৪ সালে সেখানে নতুন এক উদ্যোগ শুরু হয়, যার পোশাকি নাম ছিল ‘গ্রামের জীবন – গ্রামের মাঝে জীবন'৷ ইতিমধ্যে গোটা জার্মানিতে এই প্রকল্পকে আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ এর আওতায় গ্রামের বাইরের দিকের জমির ব্যবহারের বদলে গ্রামের কেন্দ্রস্থলের উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ এই উদ্যোগকে জনপ্রিয় করতে বিশাল আকারের প্রচার অভিযানও চালানো হয়েছিল৷
গ্রামকে বসবাসের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে স্থপতিদের নিয়ে এক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়৷ কম খরচে পুরানো অথচ আকর্ষণীয় বসতবাড়ি সংস্কারের প্রস্তাব দেন স্থপতিরা৷ সেরা প্রস্তাবগুলি বাস্তবায়ন করতে বিনিয়োগকারীদের জন্যও বিশেষ আর্থিক ভরতুকির ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ বিশেষ করে তরুণ দম্পতিরা এই প্রকল্প সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহ দেখান৷ যাঁরা সেই সব ঘরবাড়ি বেছে নেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষই এসেছিলেন শহর ছেড়ে গ্রামে থাকতে৷ মোট ১২৮টি বাড়ি নতুন করে বসবাসের উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে, প্রায় ১ কোটি ৯৫ লক্ষ ইউরো অঙ্কের বেসরকারি বিনিয়োগ এসেছে৷
গ্রামের কেন্দ্রস্থলের আকর্ষণ বেড়েই চলেছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানালেন মেয়র ক্লাউস ল্যুটকেফেডার৷ তিনি বললেন, ‘‘আসলে গ্রামের কেন্দ্রস্থলে বসবাস করার অনেক সুবিধা রয়েছে৷ সুবিধাজনক অবস্থান তো বটেই, এখানে দোকান-বাজার, ডাক্তারখানা সবই নাগালের মধ্যে৷ তাছাড়া সব বয়সের মানুষই এখানে মিলেমিশে থাকেন৷ ফলে সবারই আখেরে লাভ হয়৷ এ কারণেই জায়গাটা এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷''
শুধু ভেস্টারভাল্ড নয়, এমন প্রকল্প ছড়িয়ে পড়েছে একাধিক অঞ্চলে৷ এর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে৷ জার্মানিতে ২৪৪টি, ইইউ দেশগুলিতে প্রায় ২,০০০ অঞ্চল এর ফলে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে৷
প্রতিবেদন: কারিন ইয়েগার/এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ