গোলাপি সোমবারের কাণ্ডকারখানা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩বন শহর এবারও মেতেছে কার্নিভালের আনন্দে৷ বৃহস্পতিবার ছিল কার্নিভালের ‘নারী দিবস', সেদিন নারী যা চেয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে৷ ডয়চে ভেলের সহকর্মীরা এসেছিলেন এমন সব সাজে সেজে যে অন্য জায়গায় হঠাৎ দেখা হলে তাঁদের কাউকে চেনাই যেতো না৷
সেদিনই জানা হয়ে গিয়েছিল ‘গোলাপি সোমবার' সকালে আনন্দের নানা রং নিয়ে বসবে বিশাল এক মেলা৷ জার্মানির নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্য জুড়েই বসে এই আনন্দমেলা৷ বন শহরেও হবে৷ সেদিন আরো জানা হয়েছিল, এবার জার্মানিতে প্রথম এমন উৎসব দেখার সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশের এই সাংবাদিককেই যেতে হবে ‘গোলাপি সোমবার'-এর আনন্দ নিয়ে তা আবার ডয়চে ভেলের পাঠক-শ্রোতার মনে ছড়িয়ে দিতে৷
বড় কঠিন কাজ৷ বন শহরে শত শত মানুষ৷ তাঁদের হাজার রকমের পোশাক৷ ছেলে মানুষ পোশাক বদলে, রং করা চুল মাথায় চাপিয়ে হয়ে যায় চোখ আটকে দেয়া সুন্দরী৷ সে যে সত্যি সত্যিই হয় গিয়ে দেখার আর দরকার হলো না৷ অফিস থেকে বেরোনোর আগে এই পুরোদস্তুর পুরুষ মানুষটিকেই মেয়েদের চুল পরিয়ে, গলায় মালা ঝুলিয়ে বানিয়ে দেয়া হলো মেয়ে!
তাতে ভালো হলো এই যে, নতুন জায়গায় নতুন ধরনের এক আনন্দ আয়োজন দেখা হলো কল্পনাতীত এক সুবিধা নিয়ে৷ হঠাৎ মেয়ে হয়ে যাওয়ার সুবিধা৷ আমায় দেখে এক সুপুরুষ হাসতে হাসতে চোখ টিপে চলে যাচ্ছে – এ যেমন দেখলাম, শোনা হলো খুব কাছে এসে এক মিষ্টি মেয়ের বলে যাওয়া একটা কথা৷ হঠাৎ পেছনে একটা কিছুর আঘাত – চেয়ে দেখি আরেক জার্মান তরুণী দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে দুষ্টু হাসি হাসছে!
কার্নিভালের বাকি সময়টার মতো ‘গোলাপি সোমবার'-এরও আসল কথা হাসি৷ সে হাসি উঠে আসে মন ভরে থাকা আনন্দ থেকে৷ সুরের তালে তালে নাচো, গাও, খাও, পান করো- যতভাবে পারো আনন্দে ডুবে থাকো – কার্নিভাল বলুন কিংবা গোলাপি সোমবার, সবকিছুরই তো আসল কথা এই৷
মানুষ তো বটেই, এই পৃথিবীতে যত রকমের প্রাণী আছে বলতে গেলে প্রায় সবারই প্রতিরূপ দেখা গেল গোলাপি সোমবারে৷ বাবা এসেছেন গাছ সেজে, তাঁর কাঁধে ছোট্ট ছেলে বসে আছে ব্যাঙ হয়ে৷ গাছের সেই ব্যাঙ তাকিয়ে আছে এক ডাকাত সর্দারনীর দিকে, সেই একদিনের ডাকাতসর্দারনীর হাত ধরে আবার নেচে নেচে যাচ্ছে পরী সেজে আসা ফুটফুটে এক মেয়ে৷
কোথাও হয়তো মা নাচছেন তাঁর আদরের ছেলেকে নিয়ে, তাদের পাশেই বহু দূরে ফেলে আসা তারুণ্যকে হঠাৎ ফিরে পেয়ে জড়াজড়ি করে নাচ শুরু করেছেন বয়সে নুয়ে পড়া এক জুটি৷ বয়সে একটু প্রবীণ হলেনইবা, গোলাপি সোমবারের সৌরভে আজ তো সবাই শিশু, যুবক-যুবতী না হয় তরুণ-তরুণী – মনের বুড়ো কেউ থাকলে তো!
শহরের বড় একটা অংশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য মিছিল৷ প্রত্যেকটার পেছনে আছে স্বতন্ত্র ভাবনা, পোশাক আর চেহারায় তার প্রকাশ৷ প্রধান আকর্ষণ রাজকন্যা আর রাজপুত্র৷ তাঁরা আসতেই সবার আনন্দে ফেটে পড়ার জোগাড়৷ সঙ্গীর কাঁধে উঠে কত তরুণী যে চুমু খেয়ে এলো!
গোলাপি সোমবারে চুমুর চেয়ে অনেক বেশি খাওয়া যায় চকোলেট৷ কিনতে হবে না৷ একেকটা মিছিল আসবে, ছুড়ে ছুড়ে দেবে৷ কুড়িয়ে নিন! কুড়াতে চান? এমনি এমনি পাবেন না সে সুযোগ৷ প্রতিযোগিতায় নামতে হবে হাসিমুখে৷ নারী-শিশু-তরুণী-বৃদ্ধ – সবাই আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী৷ জিতলে সবাই হাসে, হেরেও হাসে৷ হাসতে হাসতেই ভরে যায় অনেকের সঙ্গে আনা ব্যাগ৷
এমন আয়োজন কী আর শহর বা দেশের সীমানায় বাঁধা থাকে? প্রতিবেশী সব দেশ থেকেই প্রতি বছর ছুটে আসে অন্তত একটা করে দল৷ এবার প্রথম দেখা মিছিলটা ছিল হাঙ্গেরির৷ বুদাপেস্টের সেই কয়্যারকে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম৷ পরে একটা গান শুনে বোঝা গেল রোজেন নটাগে এটাই স্বাভাবিক৷ গানটির মানে হলো, খ্রিস্টান, মুসলমান, হিন্দু বা বৌদ্ধ সবাই মানুষ আর এই উৎসব সব মানুষের৷ আসলেই তাই৷