গর্ভপাত নিষিদ্ধ, কিন্তু এমআর চলছে
৭ মার্চ ২০১৭মিরপুরের মাজার রোডে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক আছে, যেখানে এমআর-এর জন্য ভিড় লেগেই থাকে৷ একেকটি ক্লিনিকে গড়ে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি গর্ভপাতের সার্জারি হয়৷ এগুলো ‘এমআর' নামেই হয়৷ একটি ক্লিনিকের একজন পরিচালক জানান, ‘‘সাধারণত অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এড়াতেই এখানে অনেকে এমআর করাতে আসেন৷ তাদের বড় একটি অংশ বয়সে তরুণী৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘যারা আসেন তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চান৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদেরও জানাতে চান না৷ কেউ কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়েই আসেন৷''
চিকিৎসকরা জানান, মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে সেই মাসিক নিয়মিত করার এক ধরনের চিকিৎসার নামই এমআর৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের কারণেই মাসিক বন্ধ হয়৷
গার্টমেকার ইন্সটিটিউট একটি হিসাব দিয়ে বলেছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ১০০ এমআর করা হয়৷ অর্থাৎ প্রতি হাজারে এমআর করা হয় ১৮.৩ টি৷ একই বছর সরাসরি গর্ভপাতের ঘটনা ছিল ৬ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টি৷ সে বছর প্রতি ১০০০ গর্ভবতীর মধ্যে ১৮ দশমিক ২ জন গর্ভপাত করিয়েছেন৷ তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে৷
হলি ফ্যামিলি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রওশন আরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এমআর-কে বৈধতা দেয় সরকার৷ আগে এমআর করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ছিল আট সপ্তাহ, কিন্তু এখন ১২ সপ্তাহ৷ প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই এমআর-এর আলাদা বিভাগ আছে৷ প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোও বৈধভাবেই এমআর করছে৷ আমরা বলি, এমআর-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে গর্ভপাতকে এক ধরনের বৈধতা দেয়া হয়েছে৷ সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে হয়ত সরাসরি গর্ভপাতকে বৈধতা দেয়া যায় না, কিন্তু অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এড়াতে এর প্রয়োজন আছে৷''
বাংলাদেশের আইনে শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের সুযোগ আছে৷ তবে এ প্রসঙ্গে ডা. রওশন আরা বলেন, ‘‘এমআর-এর নামে ছোট ছোট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ‘গর্ভপাতের' যে ব্যবসা গড়ে উঠেছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ, সেখানে প্রশিক্ষিত ডাক্তার নাই৷ আয়া বা নার্স দিয়েই গর্ভপাতের কাজ করা হচ্ছে৷ এর ফলে কখনো কখনো গর্ভবর্তী মারা যান৷ আবার কখনো তার মা হওয়ার সক্ষমতা শেষ হয়ে যায় অথবা জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন৷ সরকারের উচিত বিষয়টি মনিটরিং করা৷''
বাংলাদেশে বেশ কিছু এনজিও তাদের হাসপাতালের মাধ্যমে এই এমআর সেবা দিচ্ছে৷ আর এখন সার্জারি ছাড়া ওষুধের মাধ্যমেও গর্ভপাত করানো হয়৷ বাংলাদেশে এখন সেই ওষুধ পাওয়া যায় বলে জানান ডা. রওশন আরা৷ তিনি বলেন, ‘‘এ কারণে এখন ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গর্ভপাত করানো হয়৷''
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না৷ এই পদ্ধতি প্রায় শতভাগ নারীর ওপরই প্রয়োগ করা হয়৷ ফলে অনাকাঙ্খিত গর্ভ ধারণের ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া সচেতনতার অভাব, জবরদস্তি ও প্রতারণা-প্রলোভনের কারণেও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটে৷
কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ৪২ দিন পর্যন্ত এমআর-এর সুযোগ দেই৷ কারণ, ওই সময় পর্যন্ত ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না গর্ভে সন্তান আছে কি নেই৷ কিন্তু এর বেশি সময় হলে আমরা কাউন্সেলিং করে মা-কে এমআর থেকে বিরত রাখি৷''
তিনি জানান, ‘‘অনেকেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তান নিতে চান না৷ অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভধারণ হলে তারা তাই এমআর করান৷''
তাঁর মতে, ‘‘জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এমআর কমে আসবে৷ আমরা তাই এখন এমআর নিরুৎসাহিত করি৷ সঠিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেই, উৎসাহিত করি৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘তবে অনেকেই সরাসরি গর্ভপাত করাতেও আসেন৷ নানাভাবে তারা অনাকাঙ্খিতভাবে গর্ভবর্তী হয়ে পড়েন৷ কিন্তু আমরা ফিরিয়ে দেই, কারণ, আইনে গর্ভপাতের সুযোগ নেই এবং আইনের চোখে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷''
আর ডা. রওশন আরা বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশে গর্ভপাত বাড়ছে৷ সেটা এমআর-এর নামে হোক বা যেভাবেই হোক৷ আর এই গর্ভপাতে সহায়তা করছে অনেক ক্লিনিক৷''
প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে পাঁচ কোটি ষাট লাখ নারীর গর্ভপাত হচ্ছে৷ বিশ্বে প্রতি চার জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে একজনের গর্ভপাত হচ্ছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷