গঙ্গা আরতির ভাবনা, ফিরবে নদীঘাটের হাল?
২২ নভেম্বর ২০২২সোমবার স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পড়েন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। গঙ্গার ঘাটের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে ক্ষোভ জানান মমতা। তার উদ্যোগে কলকাতাবাসীর বিনোদনের জন্য প্রিন্সেপ ঘাট, মিলেনিয়াম পার্কের সৌন্দর্যায়ন হয়। কিন্তু এ সব জায়গায় নদীর পাড় অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এতে দূষণ ছড়াচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
মুখ্যমন্ত্রীর ধমক খেয়ে সোমবার রাতেই নদীর ঘাট পরিদর্শনে যান ফিরহাদ। তিনি প্রিন্সেপ ঘাট থেকে জাজেস ঘাট ঘুরে দেখেন। সঙ্গে ছিলেন কলকাতার পুরসভার আধিকারিক ও স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা। নদীপাড়ে নোংরা-আবর্জনা দেখে অসন্তুষ্ট হন মেয়র। পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার ও পুলিশ সম্পর্কে ক্ষোভ জানান তিনি।
একইসঙ্গে মেয়র আঙুল তোলেন বন্দর ও রেল কর্তৃপক্ষের দিকে। ফিরহাদের দাবি, এই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে বলা সত্ত্বেও তারা নদীর ধারে নিজেদের অধীন এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখছে না। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ বিতর্কে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব সামনে এসে যায়। নদীঘাটের পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নেও যে তার ব্যতিক্রম হয়নি, তার প্রমাণ মিলছে মেয়রের বক্তব্যে।
তীর পরিচ্ছন্ন না থাকলে নদী দূষণের কবলে পড়ে। সৌন্দর্য বিঘ্নিত হওয়ার থেকে এই ক্ষতি অনেক বড়। ভারতের অধিকাংশ মানুষের কাছে গঙ্গা পুণ্যতোয়া, পবিত্র। কেন্দ্রীয় সরকার নমানি গঙ্গে প্রকল্পের মাধ্যমে গঙ্গার দূষণ রোধের চেষ্টা চালাচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্র সংসদে জানিয়েছে, এই প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও প্রচার বাবদই শুধু ১২৬ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প কি আদৌ কাজে আসছে?
কলকাতা-সহ জেলার ঘাটে ঘাটেযে ছবি দেখা যায়, তা দেখে প্রকল্পের সফলতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। ফলে নদীর দূষণ চলছেই। নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”কঠিন বর্জ্য যদি জলে মেশে, তা হলে জল দূষিত হবে, এটা জানা কথা। এতে নদীর জলের শুদ্ধতা নষ্ট হয়, ক্ষতি হয় জীববৈচিত্রের।"” দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান রুদ্র জানান, নদীর পাড় দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব পর্ষদের নয়। তারা জলের মান পরীক্ষা করে সেই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন।
নদীতে দূষণ, প্রশাসনের নজরদারি নিয়ে আলোচনা বছরভরই চলে। কিন্তু নদীর ধারে যারা আবর্জনা, ফুল, পুজোর সামগ্রী, প্লাস্টিকের খালি প্যাকেট, বোতল ফেলছেন, তাদের কোনো দায়িত্ব নেই? কারা নদীর চরে দেহ পুঁতে দেন কিংবা ভাসিয়ে দেন জলে? তীরে আবর্জনাও পোড়ানো হয় দেদার।
কল্যাণ রুদ্র বলেন, "”মানুষের সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নদীর দূষণ রোখার জন্য শুধু নজরদারি ও আইনি ব্যবস্থার কথা ভেবে লাভ নেই।"” তবে শুধু জনতার কোর্টে বল ঠেলতে রাজি নন প্রবীণ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”মানুষকে সচেতন হতে হবে ঠিকই।
একইসঙ্গে প্রশাসনের নজরদারি দরকার। ঘাট সুন্দর, গোছানো হলে মানুষই তাকে সাফসুতরো রাখবে। ঘাট ভাঙাচোরা হলে সেই ইচ্ছেই জাগবে না।"”
সোমবারের সাংবাদিক বৈঠকে নদীঘাটের অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী গঙ্গা আরতির প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি চাইছেন উত্তরপ্রদেশের ধাঁচে এ রাজ্যেও হোক আরতি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই প্রস্তাবকে নরম হিন্দুত্ব হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
পর্যবেক্ষক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "”বিজেপির সাফল্য এখানেই যে তারা অন্যান্য দলকে তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতির পথে চলতে বাধ্য করেছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য দলের দ্বিচারিতা স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর রামমন্দির উদ্বোধনে পুজো করা ভুল হলে, মুখ্যমন্ত্রীর হিন্দু রীতিতে আরতির ব্যবস্থা করাও ঠিক নয়।"
নদী বাঁচাতে আরতির ভূমিকা দেখছেন না সুভাষ দত্ত। তার বক্তব্য, "”আমাদের সবার আগে গঙ্গার শোধন করতে হবে। দূষণ ঠেকাতে হবে। নইলে ঘাট সাফাই বা আরতির আয়োজন করে লাভ হবে না। উত্তরপ্রদেশে মানুষ একটা আবেগ নিয়ে গঙ্গায় যায়, এখানে সেটারও অভাব রয়েছে।"”