গঙ্গায় মৃতদেহ, উদ্বেগ পশ্চিমবঙ্গে
১৫ মে ২০২১কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেসামাল ভারত৷ দেশে দৈনিক সংক্রমণ কমলেও পশ্চিমবঙ্গে তা বাড়ছে৷ শুক্রবার সন্ধ্যার হিসেব অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ২০ হাজার ৮৪৬ জন৷ মারা গেছের ১৩৬ জন৷ এরই মধ্যে নতুন সমস্যা তৈরি করেছে ভাসমান দেহ৷
উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে গঙ্গায় অনেক দেহ একসঙ্গে ভাসতে দেখা যাচ্ছে৷ এই দেহগুলির অধিকাংশ অর্ধদগ্ধ৷ কোথা থেকে এলো এত দেহ? অনেকে মনে করছেন, অতিমারিতে মৃত মানুষের দেহ সৎকার করতে না পেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এই ভাসমান দেহ চিন্তায় ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে৷ ঝাড়খণ্ড লাগোয়া মালদহের মানিকচক দিয়ে গঙ্গা এই বাংলায় প্রবেশ করেছে৷ দেহ ভাসতে ভাসতে এখানে এলে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে? এ নিয়ে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকার৷ জেলা পুলিশ-প্রশাসন নজরদারি রাখছে পরিস্থিতির উপর৷ নদীতে নামানো হয়েছে নৌকো, স্পিড বোট৷ রাতে আলো জ্বালিয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে৷ স্থানীয় মাঝিদের সাহায্য নিচ্ছে প্রশাসন৷ জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করছে পুলিশ৷ তাদের বাহিনীর সঙ্গে থাকছে বিশেষ দল৷ দেহ ভেসে আসার খবর পেতে পাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে জেলা প্রশাসন৷ দেহ ভেসে এলে দ্রুত তা উদ্ধার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন৷
ভাসমান দেহ কোভিডে মৃতদের কি না, তা স্পষ্ট নয়৷ মালদহ জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দেহ উদ্ধার হলে তার করোনা পরীক্ষা করানো হবে৷ তারপর নির্দিষ্ট বিধি মেনে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন৷ মৃতদেহ কোভিড রোগীর বলে নিশ্চিত হলে তা জীবাণুমুক্ত করা হবে৷ তারপর সমাহিত করা হবে মাটির গভীরে৷ এই দেহগুলি করোনা রোগীর কি না, তা পরীক্ষাসাপেক্ষ৷ যদি তাই হয়, তাহলে সংক্রমণ কি ছড়িয়ে পড়তে পারে? ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে কোষের সাহায্য নেয়৷ মৃতদেহগুলি যদি করোনা রোগীর হয়, তাহলে সেই শরীরে ভাইরাস থাকতেই পারে৷ জলে দ্রব হয়ে গেলে করোনা ভাইরাস মানুষের মধ্যে ফিরে না আসারই কথা৷ কারণ করোনা ভাইরাসের ইনার পার্টিকল নষ্ট হয়ে গেলে সেটা কিছু থাকবে না৷ কিন্তু জলদূষণ বা ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ তো হবেই৷’’
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বহু মানুষের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রে রয়েছে গঙ্গা৷ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে কুম্ভের মতো ধর্মীয় তাৎপর্যও বহন করে চলেছে এই নদী৷ আপাতত গঙ্গার জলকে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কাজে না লাগাতে বলছেন মৎস্যবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিবকিঙ্কর দাস৷ তার যুক্তি, ‘‘এই সময় নদীর জল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ ফলে মৃতদেহগুলি জলে ডাইলুটেড হচ্ছে না৷ তাই এত সংখ্যায় মৃতদেহ দূষণ করছে মারাত্মক৷ এতে নদীর বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে৷ জল আন্ত্রিক সমস্যা বাড়াতে পারে৷ তাই দূষিত হিসেবেই গঙ্গার জলকে দেখা উচিত৷’’ তাহলে কি মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে? অধ্যাপক দাস বলেন, ‘‘আঞ্চলিক স্তরে দূষণের দিকটাও মাথায় রাখতে হতে পারে৷ সেখানে মাছ ধরার ক্ষেত্রে মৎস্যজীবীরা এই দূষণের গ্রাসে পড়বেন৷ আমরা মাছ যখন খাই, সেটা হয়তো জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে৷ কিন্তু মৎস্যজীবী যারা খালি হাতে মাছ ধরেন বা বিক্রি করেন, তারা বড় সমস্যায় পড়তে পারেন৷’’
কাজেই করোনা সংক্রমণের দুর্ভাবনা সরিয়ে রাখলেও রেহাই নেই৷ এত মৃতদেহ দীর্ঘ সময় ভাসতে থাকলে জলদূষণের আশঙ্কা রয়েছে৷ নদীদূষণ আটকাতে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, শিলিগুড়ির মহানন্দা, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিদ্যাধরীর অবস্থা খুব খারাপ৷ কলকাতার একটা বড় অংশের মানুষ নদীর জলের উপর নির্ভরশীল৷ উন্নত প্রযুক্তির প্লান্টে নদীর জল শোধন করে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়৷ পরিবেশের উপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী? পরিবেশকর্মী নব দত্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘শুধু শবদেহ কেন? গত দুই বছর ধরে যথেচ্ছ পিপিই, কিট থেকে শুরু করে নানা কোভিড বর্জ্য তোর্সা, তিস্তা সহ বিভিন্ন নদীতে সরাসরি ফেলা হচ্ছে৷ কেউ তো প্রতিবাদ করেননি৷ দীর্ঘদিন ধরে আমরা নদী দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছি৷ কোনো সুরাহা হয়নি৷’’