কেমন হবে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ
১৯ মে ২০১৩ভারতীয় ফুটবলের হাঁড়ির হাল নিয়ে দুঃখটা হয়ত ইউরোপ প্রবাসীদেরই সবচেয়ে বেশি৷ যেমন এই জার্মানিতে৷ ২৫শে মে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে দু'টি জার্মান ক্লাব মুখোমুখি হচ্ছে৷ ইউরোপ জুড়ে উত্তেজনা৷ এই বন শহরে উপমহাদেশের মানুষজনকে শনিবার-রবিবার ক্রিকেট খেলতে দেখলে জার্মান বাবা সাইকেল থামিয়ে জার্মান খোকাকে বোঝান: ঐ দ্যাখ, ওকে বলে বেসবল৷
মনে আছে, তখন বোধহয় ফুটবল বিশ্বকাপ চলেছে৷ বাসস্টপে ডয়চে ভেলের এক আফ্রিকান সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হচ্ছিল৷ আইভরি কোস্টের মানুষ৷ তারাও খেলছে সেবারের বিশ্বকাপে৷ হঠাৎ জিগ্যেস করে বসলেন: তোমরা কবে আসছো বিশ্বকাপে? মনে পড়ে গেল, সত্তরের দশকের শেষ অবধি ভারত তো অন্তত এশিয়ার সেরা দলগুলির মধ্যে ছিল৷
ভারত ক্রিকেট পাগল হলো কেন?
তার একটা সম্ভাব্য কারণ, ফুটবলে আমাদের ব্যর্থতা৷ গরীব দেশের মানুষেরা ক্রিকেটের মতো ওরকম একটা বড়লোকি খেলায় সাধারণত আগ্রহী হয় না৷ ক্রিকেট খেলায় সময়ও বেশি লাগে৷ ক্রিকেট খেলায় ফুটবলের মতো ওরকম মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত রক্তগরম হয় না৷ না, ক্রিকেটের নিন্দে করছি না৷ বলছি, ফুটবল ক্রিকেটের থেকে আলাদা৷ আর ফুটবলের রোমাঞ্চ কি উত্তেজনা যে কি, তা উপমহাদেশের মানুষদের নতুন করে বোঝাতে হবে না৷
ফুটবলে আমরা মার খেলাম ঠিক সেই কারণে, যে কারণে ক্রিকেটে আমরা অবলীলাক্রমে বিশ্বের সেরা দলগুলোর মধ্যে গণ্য হই৷ ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা, সেখানে বডি কনট্যাক্ট নেই৷ ফুটবলে আবার ক্রিকেট ব্যাটের মতো কোনো মিডিয়ামও নেই৷ পা-মাথা-বাকি-শরীরই সম্বল৷ তাই দিয়েই বল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আবার বিপক্ষকে রুখতে হবে৷ ফুটবলের সরঞ্জাম বলতে দু'টো গোলপোস্ট, একটা বল, বাইশটা পা৷ ফুটবল হল প্রস্তরযুগের শিকারি আর ফলমূল সন্ধানীদের খেলা৷
ফুটবল খেলায় ভালো হতে গেলে সবার আগে চাই ‘স্ট্যাচার', অর্থাৎ শরীরটা এই বডি কনট্যাক্ট গেমের ধকল সওয়ার মতো পোক্ত হওয়া চাই৷ এটাও একটা যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে৷ দ্বিতীয়ত, আমাদের নাকি একটা বুনিয়াদি ফুটবল সংস্কৃতি এবং সেই সঙ্গে বুনিয়াদি ফুটবল ‘স্কিল' বা দক্ষতা কি পারদর্শিতাগুলোর অভাব৷ যেগুলো নাকি শেখা যাবে মুম্বই-এর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সকার স্কুল কিংবা নতুন দিল্লির নয়ডায় বাইচুং ভুটিয়া ফুটবল স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে৷
আরেকটি ‘গরীব' দেশ
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, ব্রাজিলিয়ানদের তো কোনোকালেই ইউরোপীয়দের মতো বিরাট ও তাগড়া শরীর ছিল না৷ তাহলে তাদের ফুটবলে আশ্চর্য সাফল্যের রহস্যটা কি? রহস্যটা হলো, ব্রাজিলিয়ানরা ইউরোপীয়দের মতো শরীর তৈরি করার চেষ্টা না করে, ইউরোপীয়দের মতো গাঁট্টাগোট্টা, ষণ্ডামার্কা হবার চেষ্টা না করে, তাদের নিজস্ব ফুটবল শৈলী তৈরি করে নিয়েছে – তাদের ফাভেলা নামধারী বস্তি এলাকাগুলোর অলিতে গলিতে৷
বস্তির রাস্তায় কি পোড়োজমিতে খালি পায়ে ফুটবল খেলেই ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ তারকারা বেরিয়ে এসেছে৷ নাম করব না, তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে৷ তবে ব্রাজিলের মহিলা টিমের মার্থা অথবা মার্তার নাম করা যেতে পারে, যিনি তিনবার বিশ্বের সেরা মহিলা ফুটবল খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন – চারবারও হতে পারে৷
মার্তা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: তিনি নাকি ছোটবেলায় গলিতে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে চেয়েছিলেন৷ ছেলেরা বলেছিল: ছেলেদের মতো খেলতে হবে, মেয়েলি খেলা খেললে চলবে না৷ তাই নাকি মার্তা ছেলেদের মতোই ফুটবল খেলা শেখেন৷ উনি যে অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে অন্যভাবে খেলেন, সেটা নাকি তাঁর জানাই ছিল না৷
ফুটবল শৈলী
কিন্তু ব্রাজিলের উদাহরণটা শেষ করা যাক৷ সাবেক খেলোয়াড় ডুঙ্গা কোচ হিসেবে এসে ব্রাজিল টিমের খেলার ধরন বদলে ইউরোপীয় করার চেষ্টা করেন এবং ব্রাজিল ২০১০ সালের বিশ্বকাপে ফেল মারে৷ এখন আবার ব্রাজিল তাদের পুরনো ফুটবল শৈলীতে ফেরার কথা ভাবছে৷ ভারতের ক্ষেত্রেও আমাদের ইউরোপীয় ফুটবলের অনুকরণ করে কোনো লাভ নেই, বলে আমার ধারণা৷ ফুটবলের ইস্কুল খুলে কয়েকটা সেকেন্ড ডিভিশন ইংলিশ ক্লাবের জন্য রিজার্ভ প্লেয়ার তৈরি করতেই যুগ কেটে যাবে৷
ভারতের ক্ষেত্রেও আমাদের গলির ফুটবলে ফিরে, গলিতে টুর্নামেন্ট, পাড়ায় পাড়ায় টুর্নামেন্ট, প্রাদেশিক টুর্নামেন্ট, প্রদেশে প্রদেশে টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আমাদের নিজস্ব ফুটবল শৈলী আবিষ্কার করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে৷ তারপর – ব্রাজিলের মতোই – সেই ফুটবল শৈলী নিয়ে বিশ্বের দরবারে নামতে হবে৷
একলাফে যেরকম সাহেব হওয়া যায় না, সেরকম একলাফে ফুটবলারও হওয়া যায় না৷ আর সাহেবই যে হতে হবে, সেটাই বা কে বলল?