বিশ্ব মা দিবস
১০ মে ২০১৫ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে দু'বছর আগে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে বেশ ভালো বেতনের চাকরি করছেন আহমেদ জুবায়ের৷ তাঁর বাবা আছেন, কিন্তু তিনি আলাদা থাকেন৷ তাই মায়ের সঙ্গেই থাকেন জুবায়ের৷ আসলে জুবায়েরের মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে আলাদা হয়েছেন জুবায়েরের বয়স যখন ১২, তখন৷ এরপর নিজে চাকরি করে একা হাতে সন্তানের পড়াশুনা এবং সংসার সামলিয়েছেন তিনি৷
জুবায়েরের ভাষায়, ‘‘আমি দিনের পর দিন দেখেছি বাবা কীভাবে মাকে নির্যাতন করতেন৷ তারপরও মা মুখ বুজে সব সহ্য করতেন শুধুমাত্র আমার কথা চিন্তা করে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারেননি৷ আমিও মায়ের সাথেই চলে যাই বাবার সংসার ছেড়ে আর এখনও পর্যন্ত মায়ের সঙ্গেই আছি৷ মায়ের চেয়ে বড় কিছু আমার কাছে নেই৷''
জুবায়েরের কাছে প্রশ্ন ছিল – মাকে আপনি খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছেন৷ তিনি একজন নারীও৷ তা আপনার বিবাহিত জীবনে আপনার স্ত্রী, মানে আরেকজন নারীর প্রতি আপনার আচরণ কেমন হবে? জুবায়েরের জবাব, ‘‘আমি সব নারীর প্রতিই শ্রদ্ধাশীল৷''
বাস্তবে কিন্তু সবসময় এমনটা দেখা যায় না৷ বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে যে সমস্ত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা ঠিক সেটাই প্রমাণ করে৷
নারী নির্যাতনের চিত্র এখনও ভয়ংকর
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত চার বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬৭ হাজার ২২৯টি৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১২ হাজার ৯৭১ জন৷ যৌতুক ও নানা কারণে স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দু'হাজার পাঁচজন নারী৷ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৪৪২ জন আর নির্যাতনের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে আরো এক হাজার ৬৬১ জন নারীকে৷
জাতীয় মহিলা পরিষদ গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মাত্র ছ'মাসে নারী নির্যাতনের একটি পরিসংখ্যান তৈরি করে৷ তাতে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা ভয়াবহ৷ এই ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন নারী৷ এ সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে আর ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন আরো ৫১ জন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘এখান থেকেই আমাদের স্ববিরোধিতা পরিষ্কার হয়ে যায়৷ একই নারী যখন আমার মা না হয়ে অন্য কেউ হন, তখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়৷ তাঁদের ওপর ঘরে-বাইরে সবখানেই নির্যাতন চালানো হয়৷ কোথাও তাঁরা নিরাপদ নয়৷ আমরা ভুলে যাই যে অন্য নারীটিও কারুর মা, বোন বা স্ত্রী হতে পারে৷ অবশ্য সংখ্যায় কম হলেও সন্তানের হাতে মা যে নির্যাতনের শিকার হন না, তা কিন্তু নয়৷''
গর্ভবতী মায়েদের প্রতি অবহেলা
বাংলাদেশে সন্তান প্রসবকালে এখনও মায়েদের মৃত্যুর হার বেশি৷ এর কারণ ও তাঁর প্রতি অবহেলা৷ নারীকে ছোট করে দেখার প্রবণার কারণই এই অবহেলার মূলে, মনে করেন সুলতানা কামাল৷ তাছাড়া সন্তান প্রসবকালে নারী মৃত্যুর হার কমলেও, তা সাম্প্রতিক৷ এটা সরকার ও বেসরকরি প্রতিষ্ঠানের নানা উদ্যোগ এবং সচেতনতা কর্মসূচির কারণে হচ্ছে৷ কিন্তু মানসিকতায় গর্ভবতী মায়েদের প্রতি অবহেলা থেকেই গেছে৷
সর্বশেষ পরিস্যংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ছ'জনকেই মাকেই প্রচলিত পদ্ধতি, অর্থাৎ হাতুড়ে দাই-এর হাতে সন্তান প্রসব করতে হচ্ছে৷ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীর সাহায্য পাচ্ছেন ১০ জনের মধ্যে মাত্র চারজন৷ আর শতকরা হিসেবে ৬০ জন মা এখনও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীর সেবা পাচ্ছেন না৷
এখনও প্রতি এক লাখে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৬৫ জন৷ অবশ্য ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এই হার ছিল ৩২২৷ বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর গড়ে ৬ ভাগ করে মাতৃমৃত্যুর হার কমছে৷ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ১৪৩-এ নামিয়ে এনে বাংলাদেশ এমডিজি-৫ অর্জনে সক্ষম হবে৷
তবে এর বিপরীতে খারাপ খবর হলো, প্রতি ১০ জনের মাত্র তিনজন মা গর্ভকালীন সময়ে চিকিৎসকের কাছে যান৷ এই বিপরীত চিত্রের সঙ্গে মাতৃমৃত্যুর হার কমাকে মেলানো যায় না৷ নারী ও শিশু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিবিৎসক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘গর্ভকালীন অবস্থায় মায়েদের প্রতি সেবা বাড়ার কারণ মা না ভবিষ্যৎ সন্তান – এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন৷''
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বৃদ্ধাশ্রম?
বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন প্রবীণ হয় একাকী অথবা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন৷ দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন৷ আর তাই বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও বাড়ছে৷ সরকার দেশের ছ'টি বিভাগে ছয়টি বৃদ্ধাশ্রম তৈরির কাজও হাতে নিয়েছে৷ এছাড়া একাকী এবং বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁদের ৭০ ভাগই নারী, এবং তাঁদের বেশিরভাগই কারো না কারুর মা৷
বাংলাদেশে ২০১১ সালে পাশ হওয়া পিতা-মাতার ভরনপোষন আইনে সন্তানকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, মা-বাবা যেখানে থাকতে চাইবেন তাঁদের সেখানে থাকতে দিতে হবে৷ শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে ভরনপোষনও দিতে হবে সন্তানকে৷ সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘মা-বাবা যদি স্বাধীনভাবে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চান, তাহলে কোনো কথা নেই৷ তবে তাঁদের জোর করে পাঠানো আইন এবং মানবিকতার লঙ্ঘন৷''
আইনে ভরনপোষন না দিলে সন্তানকে দু'লাখ টাকা জরিমানা এবং তিন মাসের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘বৃদ্ধ বয়সেও নারীরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হন৷ তাই আইন থেকে সুফল পেতে হলে সরকারকে ‘মনিটরিং' করতে হবে৷ কারণ বিষয়টি নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা আদালতে যেতে এখনও উৎসাহী হচ্ছেন না৷''