কেন বাড়ল না বিশ্বভারতীর উপাচার্যের মেয়াদ?
৯ নভেম্বর ২০২৩পাঁচ বছর বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকার পর বুধবার মেয়াদ শেষ হয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর। অশান্তি এড়াতে বিপুল পুলিশ বাহিনীর ঘেরাটোপে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন সাবেক উপাচার্য। তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হয়েছেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সঞ্জয় মল্লিক।
বিদ্যুৎ ও বিতর্ক
বিদ্যুতের বিদায়ের পর বিশ্বভারতীর অধ্যাপকরা মিষ্টিমুখ করেছেন। মিছিল করেছে কর্মী সংগঠন। উপাচার্য হিসেবে প্রতিনিয়ত বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন বিদ্যুৎ।
২০২১ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কেন হারল, তার কারণ খুঁজতে ভার্চুয়াল সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন বিদ্যুৎ। প্রশ্ন ওঠে, এ বিষয়ে আলোচনা কেন বিশ্বভারতীতে?
কখনো পৌষ মেলা বা বসন্ত উৎসব বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতণ্ডা হয়েছে, কখনো বা দুর্গাপুজো সম্পর্কে বেফাঁস মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছেন সাবেক উপাচার্য। শান্তিনিকেতনে বিদ্যুতের পাঁচিল গড়ার সিদ্ধান্তে বিতর্ক হয়েছে, আবার ঘনঘন তাঁকে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতেও দেখা গিয়েছে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বাড়ি ও জমি নিয়ে এই টানাপোড়েন চরমে উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে তৎপর হন। এমনকি অমর্ত্যের নোবেল প্রাপ্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন বিদ্যুৎ।
নানা অভিযোগে বিদ্ধ
সম্প্রতি শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। সেই সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলকে রবীন্দ্রনাথের নাম না থাকায় তুমুল ক্ষোভ তৈরি হয়। মেয়াদ শেষের আগে, মঙ্গলবারও বিদ্যুতের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে তিনি নাকি আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন!
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ শয়ে শয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। শোকজ, সাসপেন্ড, বদলি, চার্জশিট ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ। সাবেক উপাচার্যের কোপের মুখে পড়েন অর্থনীতির অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য।
বিশ্বভারতী শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি সুদীপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''তিনি রক্তকরবীর রাজা। যক্ষপুরীর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি হয়েছিল বিশ্বভারতীর। যত শিক্ষক, কর্মীকে বসিয়ে মাইনে দেয়া হয়েছে, তাতে ২০২২ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি ১৭ লক্ষ টাকা।''
সাসপেন্ড হওয়া পড়ুয়া সোমনাথ সৌ বলেন, ''বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর জন্ম বীরভূমে। তা সত্ত্বেও তিনি এখানকার আবেগকে গুরুত্ব দেননি। বরং নিজের শাসন চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন।''
সূত্রের খবর, এসব বিবাদ-বিরোধের নিষ্পত্তিতে শ' দেড়েক মামলায় জড়িয়ে পড়েছে বিশ্বভারতী। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে চাপ বেড়েছে। অধ্যাপক মানস মাইতিকে প্রকল্প থেকে বহিষ্কারের মামলায় বিদ্যুৎকে সরানোর পক্ষেও মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
'রক্তকরবীর রাজা' বিদ্যুৎ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী' নাটকের রাজা স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছিলেন। অনেকেই তার সঙ্গে সাবেক উপাচার্যের তুলনা করছেন। অভিযোগ, বিশ্বভারতীর খোলামেলা পরিবেশে শাসনের শৃঙ্খল পরিয়েছিলেন বিদ্যুৎ।
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী ও আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''আমরা রাহুমুক্ত হলাম। আমাদের উনি শকুন বলেছিলেন। আমাদের স্বাভাবিক মেলামেশা, যাতায়াতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। শিক্ষক, কর্মীরা আশ্রমিকদের বাড়ি এলে কর্তৃপক্ষের কোপে পড়তেন। আমি নাটক করি, অভিভাবকরা মহড়ার জন্য আমার বাড়িতে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে ভয় পান।''
তবে আশ্রমিকদের একাংশ স্বীকার করছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বভারতীতে চলে আসা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন করেছিলেন বিদ্যুৎ। সাবেক উপাচার্য বলেওছিলেন, ''আমি অনাচার বন্ধ করেছি বলে অনেকের সমস্যা হয়েছে। তাই আমাকে আক্রমণ করছেন।''
এরই মধ্যে বিশ্বভারতীর পঠনপাঠন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তৃণমূল মুখপাত্র সুদীপ রাহার দাবি, ''এখন দেশে ৯৭তম স্থানে রয়েছে বিশ্বভারতী। সার্বিক র্যাঙ্কিংয়ে যেখানে ২০১৯ সালে বিশ্বভারতী ৫৩তম স্থানে ছিল, ২০২৩-এ তা হয়েছে ১০১।''
নানা অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে ফোন করেছিল ডয়চে ভেলে। কিন্তু বারবার ফোনের ওপার থেকে 'ব্যস্ত থাকার' বার্তা শোনা গিয়েছে।
কেন বিদায় বিদ্যুতের?
অমর্ত্য সেন বিতর্ক থেকে রবীন্দ্র নামবিহীন ফলক, এমন নানা ঘটনায় রাজনীতির রং লেগেছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীর সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত বেড়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তা কার্যত তৃণমূল ও বিজেপির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মেয়াদ বাড়বে বলে জল্পনা শোনা যাচ্ছিল। যদিও তা হয়নি। এমন ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা। বিজেপি নেতৃত্বের একাংশও সাবেক উপাচার্যের 'বাড়াবাড়ি'তে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে সূত্রের খবর।
বিশ্বভারতীর সাবেক শিক্ষক অনুপম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''বিদ্যুৎ চক্রবর্তী কখনো শান্তিনিকেতনের আবেগকে গুরুত্ব দেননি। বরং বিজেপি সাজার চেষ্টা করেছেন, যাতে ওর মেয়াদ বাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পুরো বিষয়টি জানাই। তিনি সঠিক সময়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে তাকে ধন্যবাদ।''