কে নেবে কোটি মানুষের মনের যত্ন?
১৫ অক্টোবর ২০২১সেপ্টেম্বরে আত্মহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী অপু৷ কাছাকাছি সময়ে জগন্নাথ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী অমিতোষ হালদার ও ইমরুল কায়েসও আত্মহত্যা করে৷
তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এই অগ্রসর তরুণরা কেন অকালে জীবনকে বিদায় জানালেন-এমন আলোচনায় সরব হয়েছে সামাজিক মাধ্যম৷
এর মাঝেই পুরনো একটি খবর আবার সামনে আসে৷ দেশে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর প্রথম ১২ মাসের এ রকম ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে জীবনকে বিদায় জানিয়েছে বাংলাদেশে৷ হ্যাঁ, সংখ্যাটা ১৪ হাজারই৷ যা একইসময়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণকারী মানুষের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি৷
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার সুযোগ খুবই কম৷
সর্বশেষ জাতীয় সমীক্ষা বলছে, কয়েক কোটি মানুষ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় থাকলেও সেবা পান মাত্র ৭ দশমিক ৭শতাংশ মানুষ৷
সবাইকে কাঁদিয়ে অপুর বিদায়
গত এক দশকে ঢাকা বিশ্ববিবিদ্যালয়ের এক পরিচিত মুখ ছিলেন মাসুদ আল মাহাদী অপু৷ কোটা সংস্কার, ডাকসু নির্বাচনের দাবি, সাত কলেজের অধিভূক্তির প্রতিবাদসহ শিক্ষার্থীদের নানা আন্দোলনে তুমুল সক্রিয় ছিলেন মাসুদ৷ সেই সাথে পড়াশোনায়ও বরাবর ভালো ছিলেন৷
মঞ্চের বক্তব্য কিংবা শিক্ষকদের সাথে দাবি আদায়ের বিতর্ক-সব সময়ই যুক্তিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন অপু৷ সবাই তাকে চিনতো জীবনীশক্তিতে ভরপুর এক তরুণ হিসাবে৷ সেই অপু আত্মহত্যা করেছে চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর৷
তার মৃত্যুর পর প্রথম ধাক্কায় কেউই এটাকে আত্মহত্যা হিসাবে মানতে পারেননি৷ কিন্তু চিকিৎসক নিশ্চিত করার পর অনেকেই কারণগুলো খুঁজতে শুরু করেন৷ অপুকে তার নিজ বিভাগ ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষক ধারাবাহিকভাবে কম নম্বর দিতো বলে অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের অন্য এক শিক্ষক৷ এটা নিয়ে ছাত্রজীবনে হতাশা ছিল অপুর৷
তার এক বন্ধু বলেছিল, অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হলেও সেগুলো দীর্ঘসূত্রিতার কবলে পড়ে৷ পরিবারের অবস্থা, দেশের অবস্থা নিয়েও চিন্তিত থাকতো অপু৷ এ সব হতাশা আত্মহত্যায় ভূমিকা রাখতে পারে বলে কেউ কেউ অভিমত দেয়৷
তবে অপুর অন্য এক বন্ধু এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রুমমেট মোরশেদ ভূঁইয়া এ সব যুক্তি মানতে নারাজ৷
বন্ধুর স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, একটা মানুষ এমন হয় কি করে৷ এত পরিশ্রমী, এত অধ্যবসায়ী, এত মেধাবী, এত প্রতিবাদী, এত বিপ্লবী, এত মিশুক, এত বন্ধুপ্রতীম আর এত জ্ঞানী৷
‘‘এত কঠিন এবং জটিল বই ওকে পড়তে দেখেছি, যেই বইগুলোর দুই-তিন পাতা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে এইসব আমার মাথায় ঢুকবে না’’
অপু সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখতো৷ একবার বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার ১০ মিনিটের একটি ‘মনোলগ' পিনপতন নিরবতায় শুনেছে মিলনায়তনভরা দর্শকরা৷
এ সব স্মৃতির কথা উল্লেখ করে মোরশেদ বলেন, অপু আসলে মানসিক কিছু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে হয়ত নিজের জীবনাবসানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ আমাদের ব্যর্থতা, আমরা অপুর মেধা আর প্রজ্ঞাকে সমাজের কাজে লাগাতে পারিনি৷ সুযোগ করে দেইনি ওর স্বপ্নের পিছনে ছুটতে৷ স্বপ্ন থেকে সরে গিয়ে যখন ও দিন দিন ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছিল, তখন তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসিনি৷ সিম্পলি ভুলে গিয়েছিলাম, অপু নামের একটা সম্ভাবনাময় তারা চানখারপুলে একটা ছোট্ট কক্ষে প্রতিদিন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে৷
‘‘লাইব্রেরিতে বসে একই বিষয় বার বার পড়তে পড়তে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে অপু৷ সেই কঠিন কঠিন বই পড়া অপু, গগন কাঁপানো স্লোগান দেওয়া অপু, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামনে থেকে প্রতিবাদ করা অপু- অনেক আগেই মরে গিয়েছিল৷ সেদিন মরেছে চানখারপুল আর লাইব্রেরিতে ধুঁকতে থাকা অপু৷’’
‘আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার মানুষ’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সময়ে আত্মহত্যার হার নিয়ে ২০২১ সালের মার্চে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন৷
দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তথা ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য, পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত ডেটা বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি দেখিয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে৷ যা এর আগের বছরের চেয়ে ৪ হাজার জন বেশি৷
আত্মহত্যার এই সংখ্যাটি ওই নির্দিষ্ট সময়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যার চেয়েও বেশি ছিল৷
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা, যা মোট সংখ্যার ৪৯ শতাংশ৷ এরপরেই সব থেকে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মানুষেরা, ৩৫ শতাংশ৷ ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সী আত্মহত্যাকারী ১১ শতাংশ এবং ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৫ শতাংশ৷
মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিয়ে আত্মহত্যার এই হার কমানো সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি৷ এ জন্য তারা নিজেরাও প্রচার প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিং-ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছে৷
কত কোটি মানুষ মানসিক সমস্যায়?
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর কত মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে-এটার কোন হিসাব কারো কাছে নেই৷ মানসিক রোগের বিস্তার সম্পর্কে জানতে দুটি জাতীয় সমীক্ষার তথ্য পাওয়া যায়, উভয়টি করোনাভাইরাস পূর্ব সময়ের৷
এর একটি হয়েছিল ২০০৩-০৫ সালে৷ এই সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, এখানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত৷ ২০১৮-১৯ সালে পরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা হয়৷ এতে দেখা মানসিক রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে৷
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য মতে, বাংলাদেশের এখনকার জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬৮লাখ৷ এই জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮০ লাখ৷ অর্থ্যাৎ করোনাভাইরাসের কারণে যদি বাংলাদেশে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের হার নাও বেড়ে থাকে, তাহলেও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৮০লাখ৷
বিপরীতে দেশে মনোচিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা ৯০০জনের মত, এমনটাই বললেন এই খাতে কাজ করা সংস্থা ‘মনের বন্ধু'র সিইও তৌহিদা শিরোপা৷
২০১৮-১৯ সালের সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্তদের মাত্র ৭ দশমিক ৭শতাংশ চিকিৎসা পায়৷ বাকী ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ থেকে যায় বাইরে৷
সাহায্য চাইছে ৩০০গুণ মানুষ
বেসরকারি সংস্থা ‘মনের বন্ধু' যাত্রা শুরু করে ২০১৬৷ যাত্রা শুরুর পর থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পরামর্শ সেরা দিয়ে আসছে সংস্থাটি৷ ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর হঠাৎ করেই বেড়ে যায় সেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা৷
মনের বন্ধুর ফাউন্ডার ও সিইও তৌহিদা শিরোপা ডয়চে ভেলেকে বলেন, করোনাভাইরাস শুরুর পর জুন পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩২ হাজার মানুষ ফ্রি কাউন্সিলিং দিয়েছি৷ এর মধ্যে ৬০ শতাংশই তরুণ৷ এত মানুষ
যে সাহায্য চেয়েছে, এতেই বোঝা যায়, অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে মহামারীতে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়েছে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার সংস্থার কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যাশীর সংখ্যা করোনাভাইরাস আসার পর বেড়েছে ৩০০গুণ৷
অবশ্য তিনি মনে করেন, আক্রান্তদের সংখ্যা একই হারে বাড়েনি৷ অনলাইন সেবার প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও সেবাগ্রহণকারীর এই সংখ্যা বেড়েছে৷
আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এত দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের এত ব্যবস্থা অতীতে ছিল না৷ এ সময়ে কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই নয়, আরো অনেক নিরাপত্তাহীনতা জীবনে এসেছে৷
‘‘শুরুর দিকে অনেকে বলতো, আমার যদি করোনা হয়ে যায়, তাহলে কী করবো-এই ভয়টা তখন ছিল৷ কেবল নিজেকে নিয়ে নয়৷ নিজের এবং চারপাশের মানুষদের নিয়েও ছিল ভয়৷ পরের দিকে ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি বেড়ে গেছে৷’’
বিষন্নতার বড় শিকার তরুণ-যুবারা
মহামারীর এই সময়ে তরুণ-তরুণীদের অবস্থা জানতে আঁচল ফাউন্ডেশন ‘করোনায় তরুণ তরুণীদের মানসিক বিপর্যয়' শীর্ষক একটি জরিপ করে, যার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের জুলাই মাসে৷ এতে দেখা যায়, ৬১ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন৷ জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী এ সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন৷ শারিরীকভাবে নিজের ক্ষতি করেছেন ২৯ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যেটাকে আত্মহত্যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি৷ ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন৷
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, এর আগে আত্মহত্যা নিয়ে আমরা আরেকটি জরিপ করেছিলাম৷ সেখানে আমরা দেখেছি, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২১ সালের ফেব্রুয়ারি সময়কালে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেছে৷ যাদের ৪৯শতাংশই ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের৷ এরপর আমরা তরুণ-তরুণীদের মানসিক অবস্থা বুঝতে এই জরিপটি করি৷
‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর করোনা মহামারীর প্রভাব: একটি প্রায়োগিক জরিপ'- শীর্ষক আরেকটি কাজ করে আঁচল ফাউন্ডেশন, যার ফলাফল চলতি অক্টোবরে প্রকাশিত হয়৷
জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪.৬ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন৷ এর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০.৩৮ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থীদের ৮৭.৪৪ শতাংশ এই মহামারীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভোগা পরিবার, সমাজ ও দেশকে নিঃসন্দেহে আতঙ্কিত করে তোলে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তানসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের যে অংশটা ডিপ্রেশনে ভুগছে৷ এদের কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে৷
"কারণ ডিপ্রেশনে ভুগলে পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে না তারা৷ এরা যখন ৮-১০ বছর পর সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় জায়গায় যাবে৷”
"তখন তাদের প্রোডাক্টিভিটি কমার বিষয়টা স্পষ্ট হবে৷ তখন দেশেরও প্রোডাক্টিভিটি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ এখনই তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভবিষ্যতে দুরবস্থা তৈরির একটা সমূহ সম্ভাবনা আছে৷”
পিছিয়ে চিকিৎসা-পরামর্শে-এসডিজি লক্ষ্যে ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর একটি ‘সিচুয়েশনাল এসেসমেন্ট' প্রকাশ
করে৷ এতে বলা হয়, বাংলাদেশে মনোচিকিৎসক রয়েছে ২৬০জন৷ সে হিসাবে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য দশমিক এক ছয় জন মনোচিকিৎসক রয়েছেন৷
আর দেশে মনোবিজ্ঞানী রয়েছে ৫৬৫ জন৷ সে হিসাবে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য দশমিক তিন চার জন মনোবিজ্ঞানী আছেন৷ এরা সবাই মোটামুটি শহর এলাকাতেই সেবা দিয়ে থাকেন৷ আর সাইকিয়াট্রিক নার্স আছে ৭০০জন৷
দেশে মানসিক হাসপাতাল রয়েছে ২টি, যেখানে মোট বেড ৭০০টি৷ এছাড়া ৫৬টি হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে আরো ৫০৪টি বেড রয়েছে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাইকোসোশ্যাল ইন্টারভেনশনের' জন্য যোগ্য জনবলের অভাব সর্বত্র রয়েছে৷ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স পাওয়া গেছে কেবল দুই হাসপাতালে৷ যেখানে অন্য কোন হাসপাতালেই নেই বিশেষায়িত নার্স৷
লুনাসি অ্যাক্ট-১৯১২ রহিত করে ২০১৮ সালে পাস হয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন৷ ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি' প্রণীত হয় ২০১৯ সালে, যা এখনো মন্ত্রিসভার সম্মতির অপেক্ষায়৷ অন্যদিকে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-৩০' এর খসড়া ২০২০ সালে চূড়ান্ত হয়৷ এই পরিকল্পনা সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু এটিও এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি৷
তবে এর মাঝেই চলে এসেছে করোনাভাইরাস৷ এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বহু কিছুই বদলে গেছে৷
এখানে মনে রাখতে হবে এসডিজি প্রণীত হয়েছে এই ২০৩০ সালকে সামনে রেখেই৷ যেখানে বাংলাদেশের সরকারি দপ্তরে দপ্তরে এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখতে মাসে মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন করা হয়, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে করা জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত অনুমোদনই পায়নি৷ পরিকল্পনায় ২০২০ সালকে শুরুর বছর হিসাবে বিবেচনা করলেও অনুমোদনের আগেই পার হয়ে যাচ্ছে ২০২১ সালও৷
এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে এসডিজির মতো আকাশচুম্বী করি নাই৷ আমরা আমাদের লক্ষ্যকে সেখান থেকে কিছুটা কমিয়ে নির্ধারণ করেছি৷
"যেমন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি ১০শতাংশ হ্রাস করা৷ গ্লোবাল প্ল্যানে হয়ত এটা ২০শতাংশ আছে৷ আমরা আমাদের লিমিটের মধ্যে পরিকল্পনার করার চেষ্টা করেছি৷”
তিনি বলেন, এ সব নীতি ও পরিকল্পনা নেয়ার সময় করোনাভাইরাস ছিল না৷ মহামারী আসার পর কিছু কিছু পরিকল্পনা পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে৷ কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যে হারে বাড়ার কথা ছিল, এখন তার চেয়ে দ্রুত হারে বাড়ে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের যেহেতু মনোচিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীদের সংখ্যার সংকট রয়েছে৷ তাই আমরা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের সকল ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের নানা মেয়াদে প্রশিক্ষণের প্রস্তাবনা আছে৷ ৩দিন থেকে ৮৫দিন মেয়াদে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে৷ কিছু কিছু প্রশিক্ষণ এখনই চালু আছে৷ বাকীগুলো চালু করা হবে৷
"কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার থেকে চিকিৎসক পর্যন্ত সবাই এই প্রশিক্ষণ পাবেন৷”
করোনাভাইরাসের সময়কার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে কী করা উচিত-এমন প্রশ্নে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সরকারের লিড এজেন্সি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ডয়চে ভেলেকে বলেন,কিছু মানুষকে ধরে চিকিৎসা করলেই সমস্যা সমাধান হবে না৷ এর জন্য সবকিছুকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আসতে হবে৷ আর এরই মধ্যে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে সাহায্য করা৷
দীর্ঘমেয়াদের করণীয় প্রশ্নে তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটা প্রসঙ্গ এবং এটা কীভাবে কীভাবে এফেক্টেড হতে পারে-সে সম্পর্কিত আইডিয়া থেকে সবকিছুতে এই বিবেচনা নিয়ে আসা দরকার৷
‘‘যেমন, নগর পরিকল্পনা-ভবন পরিকল্পনা থেকে অফিস-স্কুল কীভাবে চলবে-সবকিছুতেই মানসিক স্বাস্থ্য প্রসঙ্গ নিয়ে আসতে হবে৷ এটা হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য প্রমোশন৷ এটা মানসিক স্বাস্থ্যের এক ধরনের পরিচর্যা৷ এটা ঠিক চিকিৎসা না৷ এটাকে পজেটিভভাবে দেখা৷ এতে বড় একটা সংখ্যক মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হবে না৷”
‘‘আর পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা৷ যারা এ সব পদক্ষেপের মধ্যেও আক্রান্ত হবেন, তারা যেন চিহ্নিত হন এবং সেবা পান৷ এটা একটা সার্বিক পরিকল্পনা৷ দুইটা মুখই থাকবে এখানে৷ এভাবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়কে হ্যান্ডেল করতে পারি৷”