‘করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য-বিপর্যয়, আত্মহত্যা বেড়েছে’
১৫ অক্টোবর ২০২১ডয়চে ভেলে : বলা হচ্ছে, করোনায় মানসিক স্বাস্থ্যের চরম বিপর্যয় হয়েছে। আসলে পরিস্থিতি কি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার : মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টা একটা বড় ব্যাপার। আমরা যেন মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক রোগকে এক না করে ফেলি। মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় মানে যে মানসিক রোগ হয়ে গেছে সে কথা বলা যাবে না। এখন আমরা বলছি, মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক অবস্থায় নেই, সেটা করোনাতে মারাত্মক বিপর্যয় হয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রথম বছরেই বিষন্নতাজনিত রোগ পাঁচ গুণ এবং উৎকণ্ঠাজনিত রোগ ১০ গুণ বেড়েছে। আসলে কি পরিস্থিতি এমন?
আমি যখন বলব, বিষন্নতাজনিত রোগ বা উৎকন্ঠাজনিত রোগ এগুলোর কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট ক্যাটাগরি আছে। এগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে থাকলে আমি বলব যে, এই রোগ হয়েছে। আবার আমি বিষন্নতায় ভুগছি, কিন্তু এটা এমন পর্যায়ে যায়নি যে এটাকে আমি রোগ বলতে পারি। কিংবা আমি উদ্বেগ বোধ করি, কিন্তু এটা এমন পর্যায়ে যায়নি যে এটাকে আমি রোগ বলতে পারি। তাহলে যেটা দাঁড়াচ্ছে যে, আমি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেশি বিষন্ন বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেশি উদ্বিগ্ন কিন্তু বিষয়টা এমন না যে আমি রোগে পড়ে গেছি। জরিপগুলো যখন হয়েছে তখন এভাবে করা হয়েছে। এখানে রোগ আর সমস্যা এর মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, এটা স্বাভাবিক অবস্থা না।
মানসিক স্বাস্থ্যের যে বিপর্যয় ঘটেছে সেটা কি চিকিৎসা সংক্রান্ত নাকি মানুষ আর্থিকভাবে চরম সংকটে পড়ার কারণে এই বিপর্যয়টা আরও বেড়েছে?
মানসিক স্বাস্থ্যের যে বিপর্যয় ঘটে তার তিন ধরনের কারণ আছে। একটা জৈব বিষয়, একটা সাইকোলোজিক্যাল এবং আরেকটা হলো সোশ্যাল। বায়োলজিক্যাল বা জৈব বিষয়টা হচ্ছে, করোনার কারণে আপনার ব্রেন আক্রান্ত হতে পারে এতে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় হতে পারে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়নি এমন লোকও করোনাকালে কোনো না কোনোভাবে এ্যাফেকটেড। সবচেয়ে বেশি মানুষ এ্যাফেকটেড হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে। এটা আমরা সবাই জানি এবং বিভিন্ন গবেষণায়ও প্রমাণিত। করোনাতে মানুষ সামাজিকভাবেও আক্রান্ত হয়েছে। এটা কী? আমাদের সামাজিক দূরত্ব মানতে হয়েছে। আমাদের বিনোদন সবকিছু বাধাগ্রস্থ হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল, শিশু কিশোরেরা খেলাধূলা করতে পারেনি, সবকিছু মিলে এক ধরনের সামাজিক বিপর্যয় হয়েছে। এই আর্থিক ও সামাজিক বিষয়গুলো মানুষকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করেছে। পাশাপাশি করোনাভীতির একটা বিশাল চাপ সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর পড়েছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবটাই পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
গত এক বছরে ১৪ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা অন্য বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এটা কি মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের কারণে নাকি অন্য কোন কারণে?
মানসিকস্বাস্থ্য কিন্তু আলাদা করা যায় না। ডাব্লিউএইচও এর যে সংজ্ঞা সেটাই সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা। স্বাস্থ্য হচ্ছে পরিপূর্ণ শারীরিক, মানষিক ও সামাজিক সুস্থ্যতা। মানষিক স্বাস্থ্য কিন্তু নানা কারণে আক্রান্ত হতে পারে। শারীরিক কারণেও হতে পারে, সামাজিক কারণেও হতে পারে। এইটার একটা প্রকাশ হচ্ছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যা যখন কেউ করে তখন সে মানসিক সমস্যায় ভুগুক আর না ভুগুক তাতে কিছু এসে যায় না, যখন সে আত্মহত্যা করে তখন সে স্বাভাবিক ছিল না। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কখনই আত্মহত্যা করতে পারে না। এটা করার সময় সে কোনভাবেই সুস্থ ছিল না। অনেক সময় মানসিক রোগাক্রান্ত হলেও করে। করোনাকালে নানা ধরনের চাপ বেড়ে গেছে, এই কারণে আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। যেমন ধরেন স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার পর কেউ আত্মহত্যা করল, আপনার মনে হবে এখানে তো করোনার কোন বিষয় নেই। কিন্তু এখানেও করোনার বিষয় থাকতে পারে। করোনার কারণে হয়ত স্বামীর উপার্জন কমে গেছে, এ নিয়ে সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে। সেটা থেকে এই ঝগড়া। বাহ্যিকভাবে আপনার মনে হতে পারে করোনার কারণে হয়ত এটা হয়নি, কিন্তু আপনি যদি তলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন করোনা কোন না কোনভাবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা দেখেছি, করোনাকালে আত্মহত্যা অনেক বেড়ে গেছে।
করোনার মধ্যে যে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় সেটা কি নারীদের বেশি না পুরুষদের বেশি ঘটেছে?
এই ধরনের কোন ডেটা আছে বলে আমার জানা নেই। যে অসুখগুলোতে বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেখানে নারী-পুরুষের খুব একটা পার্থক্য আমরা পাই না। কিন্তু যেসব অসুখগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক এবং আর্থসামাজিক ফ্যাক্টরগুলো ভূমিকা পালন করে সে ক্ষেত্রে মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আমাদের এখানে পরিবারে হোক, সমাজে হোক মেয়েরাই অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার। সে হিসেবে আমরা অনুমান করতে পারি, করোনাকালে মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের বেশি বিপর্যয় ঘটেছে।
মানসিক অবসাদে ভুগছেন কোন বয়সের মানুষ সবচেয়ে বেশি?
এক্ষেত্রেও আমাদের কাছে খুব বেশি ডেটা নেই। এরজন্য জাতীয়ভাবে স্টাডি করতে হবে। এটা সময় সাপেক্ষও। আমাদের স্টাডি যেটা হয়েছে সেটা ২০১৮-২০১৯ সালে। পরে করোনাকালে যে স্টাডি হয়েছে সেটা জাতীয়ভাবে হয়নি। এগুলো ছোট ছোট স্যাম্পল নিয়ে হয়েছে। ফলে নিশ্চিতভাবে এটা বলা সম্ভব নয়।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মহামারির প্রথম বছরে বিশ্বব্যাপী হতাশা ও উদ্বেগের ঘটনা এক-চতুর্থাংশের বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে নারী ও তরুণদের মধ্যে তা বেশি প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের চিত্রটা কেমন?
বাংলাদেশেও এমন চিত্র পাব আশঙ্কা করছি। আশঙ্কা কেন বলছি? আমাদের তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এই বিবেচনাতে যে, তাদের ছোটাছুটি করার সময় কিন্তু তারা গৃহবন্দি হয়েছে। বিশেষ করে যারা শিক্ষার শেষ পর্যায়ে তাদের এখন চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়। কিন্তু চাকরিতে যোগ দিতে পারছে না এতে তারা মানসিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আর নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি হল তারা তো পরিবারকে ধরে রাখে। তাদের তো ম্যানেজ করতে হয় সবকিছু। ফলে তাদের উপর চাপটা পড়ে বেশি। এই কারণে বলছি, আমাদের দেশেও চিত্রটা এমন হবে এটাই স্বাভাবিক।
মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের ফলে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে সমাজে বা পরিবারে?
এগুলো কিন্তু গবেষণা করে সুনির্দিষ্ট উত্তর দেওয়ার প্রসঙ্গ। আমরা যে কেসগুলো পাচ্ছি সেগুলো বিশ্লেষণ করে বলতে পারি। সেটা হল, কোন পরিবারে কেউ যদি মানসিকভাবে স্বাভাবিক না থাকেন তখন তার প্রভাব অবশ্যই অন্যদের উপর পড়ে। যেমন ধরে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি অসুস্থ থাকেন তাহলে পরিবারের উপর আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে। অন্যদিকে পরিবারের কর্ত্রী বা মা যদি অসুস্থ থাকেন তাহলে পরিবারটি ছন্নছাড়া হয়ে যায়। আর যদি সন্তানরা অসুস্থ থাকে তাহলে বাবা-মা সবার উপরই এর প্রভাব পড়ে।
করোনার মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও এখন বৈশ্বিক আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কি?
করোনার মধ্যে কিছু ভালো দিকও আছে। করোনায় আমরা বাধ্য হয়েছি ডিজিটাল প্লাটফরম ব্যবহার করতে। আমাদের যে ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হচ্ছিল, সেটা কিন্তু করোনা আমাদের ঠেলে অনেক দূর নিয়ে গেছে। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হল, মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টা কখনই আমাদের মনোযোগে ছিল না। করোনা আমাদের দেখিয়েছে এদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। আমাদের সার্বিকভাবে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতিতে মনোযোগ দিতে হবে। আমি যদি একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারি, খাদ্যের ব্যবস্থা করতে না পারি তাহলে তাকে তো আমি শুধু বুঝিয়ে বা ওষুধ দিয়ে তো তার মন ভালো করতে পারব না। তার এই চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। মূল কথা হল আমাদের আর্থসামাজিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে।
বরাদ্দ বাড়িয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো কি হতে পারে?
মানসিক স্বাস্থ্য একটা নাজুক বিষয়। আপনার শরীর যদি ঠিক না থাকে তো আপনার মন খারাপ হবে। আবার আপনার যদি আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো না থাকে তাহলেও আপনার মন খারাপ হবে। মূল কথা হল, আপনার মন ভালো রাখতে হবে। মনের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যারা আক্রান্ত হয়ে গেছে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে শুধু একটা রোগ হিসেবে বিবেচনা করলে এর সমাধান হবে না।