কুড়িগ্রামে ‘বিবস্ত্র করে’ সাংবাদিক নির্যাতন
১৪ মার্চ ২০২০পুলিশ ছাড়া আনসার নিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দরজা ভেঙে আরিফুলের বাসায় ঢোকেন৷ এরপর তাকে মারধর শুরু করেন৷ পরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে ‘বিবস্ত্র' করে নির্যাতন করা হয়৷ তার ভিডিও ধারণ করা হয়েছে৷ শুক্রবার রাতে কুড়িগ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে৷
আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেন আমার স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে আমরা জানি না৷ দরজা ভেঙে ৭/৮ জন বাসায় ঢোকে৷ এরপরই পেটাতে শুরু করে৷ কী অপরাধ জানতে চাইলে আরো বেশি মারতে থাকে৷ এক পর্যায়ে টিনের বেড়া ভেঙে ওকে নিয়ে যায়৷ প্রথমে তো আমরা জানতামই না, কারা নিয়ে গেছে? ধরার সময় শুধু বলেছে, তুই অনেক জ্বালাইছিস৷ পরে আমি কারাগারে দেখা করি৷ তখন সে দাঁড়াতেই পারছিল না৷ আমাকে বলল, বিবস্ত্র করে পিটিয়েছে৷ দুটি কাগজেও স্বাক্ষর নিয়েছে৷’’
আরিফুলকে আটক অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা৷ তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘অভিযানের সময় তার কাছ থেকে আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে৷ এই অপরাধ তিনি স্বীকার করায় তার এক বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷'' তবে আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘বাসাতে তারা কোন তল্লাশি করেনি৷’’
কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও একুশে টেলিভিশনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আতাউর রহমান বিপ্লব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত বছরের মাঝামাঝি আরিফুল একটা রিপোর্ট করেছিলেন, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন৷ ওই সংবাদের পর তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি৷ এছাড়া সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে রিপোর্ট করতে চেয়েছিলেন আরিফ৷ এ বিষয়ে জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়৷ এসব কারণে ডিসি তার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন৷ আর তার বিরুদ্ধে মাদকের যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা আদৌ সত্যি নয়৷ আরিফুল মদ বা গাঁজা তো দূরে থাক সিগারেটও খান না৷ শুধুমাত্র প্রতিহিংসার কারণেই তাকে মধ্যরাতে গ্রেফতার ও সাজা দেওয়া হয়েছে ৷ আমরা বলেছি, ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে না দিলে কঠোর আন্দালন গড়ে তোলা হবে৷’’
শনিবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সাংবাদিক মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়৷ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘‘আরিফুলের ওপর যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে৷ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়৷ মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট ও সাজা কোনও কিছুই আইনসম্মত নয়৷ ডিসি বলেই সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়৷’’
এরপরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ শনিবারই কমিটির সদস্যরা আরিফুলের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন৷
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আধা বোতল মদ আর দেড়শ গ্রাম গাঁজার জন্য মধ্যরাতে যেভাবে অভিযান চালানো হয়েছে তা অস্বাভাবিক৷ যেহেতু আরিফুলের কাছে ক্ষতিকর কিছু ছিল না, তাহলে ভোর পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট অপেক্ষা করতে পারত৷ কিন্তু তারা যেভাবে ধরে ডিসি অফিসে নিয়ে সাজা দিয়েছে তা স্বাভাবিক নয়৷ এখানে অবশ্যই আইনের ব্যত্যয় হয়েছে৷’’
ঘটনার পর থেকে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷ তবে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘গ্যাপ' থাকলে দেখা হবে৷ টাস্কফোর্সের অভিযান ছিল৷ এটা ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করেছে রেগুলার শিডিউলের অধীনে৷ সঙ্গে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের লোক, পুলিশ, আনসার ছিল৷’’
পুকুর নিজের নামে নামকরণ করা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আরিফুলের বিরুদ্ধে এরকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো এক বছর আগের ঘটনা৷ আর রিপোর্টটিও মিথ্যা৷ এরকম কিছু হলে তো তখনই হতো৷ আর এই রিপোর্টের জন্য তো সে স্যরি বলেছে৷ আমরা ভিনডিকটিভ (প্রতিহিংসাপরায়ণ) না৷’’
তবে জেলা প্রশাসকের এই বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি৷ পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই অভিযানের সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই৷ পুলিশ জানিয়েছেন, এই অভিযানে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল না৷
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘ইতোমধ্যে একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার কুড়িগ্রামে চলে গেছেন বিষয়টি তদন্ত করতে৷ অবশ্যই টাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার একটি টাইম ফ্রেম দেওয়া আছে৷ সেটি অমান্য করা সরকার ও প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর৷’’
৫ দিন নিখোঁজ সাংবাদিক, জানেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
গত মঙ্গলবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল৷ এর আগে সোমবার মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন৷ সেই মামলায় মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান, রিপোর্টার আল আমিনসহ ৩২ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ এই মামলার তিন নম্বর আসামি শফিকুল৷ শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন তার স্ত্রী৷ তার নিখোঁজের বিষয়ে বংশাল থানায় জিডিও করেছে তার পরিবার৷ সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনও করা হচ্ছে৷ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদও ছাপা হয়েছে৷
অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এমন একজন সাংবাদিক নিখোঁজ তিনি জানেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে ফেক নিউজও হয়৷ মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে মামলা সেখানে তো ওই এমপি সাহেব তো তার কাছে প্রমান চেয়েছেন এমনটাই লিখেছেন৷ সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হলে আমরা তো মামলা নিচ্ছি, তদন্ত করে ব্যবস্থাও নিচ্ছি৷’’
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময়ও কয়েকজন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন৷ পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয় কয়েকজনকে৷ এই ঘটনায় কয়েকজনকে র্যাব গ্রেফতার করে৷ তবে অধিকাংশই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন৷
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার-মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডে ৮ বছরে ৭১ বার পেছানোর পরও জমা পড়েনি তদন্ত প্রতিবেদন৷ এই পরিস্থিতি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে৷ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার হয় না বলেই নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেছে৷