কুলভূষণকে বাঁচানোর শেষ উপায় কী?
২২ মে ২০১৭গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে পাকিস্তান এক ভারতীয় নাগরিক কুলভূষণ যাদবের ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেছিল৷ এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছিল ভারত৷ আদালত যাদবের ফাঁসির উপর স্থগিতাদেশ দেয়৷ কিন্তু পাকিস্তান বলেছে, তারা ওই রায় মানবে না৷ ইসলামাবাদের এই মন্তব্যের পর ফের জল গড়াতে শুরু করে৷ আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারপতি রনি আব্রাহাম ফের পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘‘এই মামলায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার রয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতের৷’’ সেইসঙ্গে তিনি আরো জানান, আদালতের নির্দেশ, ‘‘আগামী আগস্ট মাসে চূড়ান্ত রায়ের ঘোষণার আগে যাদবের ফাঁসির শাস্তি কার্যকর করা যাবে না৷’’ পাকিস্তান অবশ্য এখনও দাবি করে চলেছে, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মানতে তারা বাধ্য নয়৷ এই রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দুনিয়া৷ পাকিস্তান দাবি করে আসছিল, কুলভূষণ একজন ভারতীয় গুপ্তচর৷ ইসলামাবাদের মাটিতে নাশকতামূলক কার্যকলাপে যুক্ত৷ অভিযোগ, কোনও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না হেঁটে সরাসরি যাদবকে ফাঁসির সাজা শোনায় পাক সামরিক আদালত৷ ভারত অন্তত ১৬ বার যাদবের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে আবেদন জানায়৷ কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তান সেই দাবি উড়িয়ে দেয়৷ এমনকি, কুলভূষণের পরিবারকে ভিসা দিতেও অস্বীকার করে ইসলামাবাদ৷ ভারতীয় নৌ-সেনায় কর্মরত ছিলেন কুলভূষণ৷ অবসরগ্রহণের পর ইরানে ব্যবসা করতেন৷ বৈধ পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র'-এর এজেন্ট সন্দেহে তাঁকে আটক করা হয়৷ গত ১০ এপ্রিল ভারতীয় নৌসেনার এই প্রাক্তন অফিসারকে গুপ্তচরের তকমা দিয়ে কার্যত বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনায় পাকিস্তানের সামরিক আদালত৷ এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ভারত৷ শেষ পর্যন্ত 8 মে এই ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয় ভারত৷ দু'পক্ষের বক্তব্য শোনার পর পাকিস্তান কার্যত তুলোধোনা করে কুলভূষণের ফাঁসির নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করে আন্তর্জাতিক আদালত৷ আগামী ১৭ আগস্ট কুলভূষণ যাদব মামলায় চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত৷
বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তান কি আদৌ এই রায় মানবে? যদি না মানে, তাহলে ভারতের কী করণীয়? আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান যদি এই রায় মানতে অস্বীকার করে, তাহলে ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে আর্জি জানাতে পারে৷ তাঁদের মতে, কোনও দেশের অভ্যন্তরীন আদালত কোনও নির্দেশকে কার্যকর করতে যতটা চাপ দিতে পারে, আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালতের হাতে ততটা ক্ষমতা নেই৷ আর এক্ষেত্রে পাকিস্তান বলতেই পারে, তারা এই নির্দেশ মানবে না৷
এখন কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবতী বলছেন, ‘‘পুরো বিষয়টিতে এখন তিনটি সম্ভাবনা রয়েছে৷ এক, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাতে পারে পাকিস্তান৷ সেক্ষেত্রে দেশের প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল সওয়াল করতে পারেন৷ দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান কিছুটা সময় কেনার চেষ্টা করতে পারে৷ যেহেতু আন্তর্জাতিক জনমত এখন ফাঁসির সাজার বিরুদ্ধে৷ সেই কারণেই বিষয়টা থিতিয়ে যাওয়ার জন্য কিছুটা সময় তাদের প্রয়োজন৷ এবং তৃতীয়ত, কুলভূষণকে মুক্তি দেওয়ার শর্ত হিসেবে ভারতের সঙ্গে খানিকটা ‘দরদাম' করে কূটনৈতিক কোনও দাবি আদায় করার চেষ্টা চালাতে পারে পাকিস্তান৷’’
তবে, এই প্রসঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র গোপাল বাগলে বলেছেন, ‘‘এটা পরিস্কার, পাকিস্তান কুলভূষণ যাদবকে আর ফাঁসি দিতে পারবে না৷ তিনি এখন নিরাপদে আছেন৷ যাদবের অধিকারকে খর্ব করলে আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করবে পাকিস্তান৷ আশা করি, পাক সরকার এই রায়টি ভালোভাবেই শুনেছে৷’’
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান যদি শেষ অবধি এই রায় না মানে, তাহলে ভারত পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর জন্য রাষ্ট্রসংঘের কাছে দরবার করতেই পারে৷ তাঁদের আশঙ্কা, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে এটাই বোঝাতে চাইছে যে, কুলভূষণের ব্যাপারটি পুরোটাই তাঁদের অভ্যন্তরীন বিষয়৷ এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় তাঁরা মানতে বাধ্য নয়৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধরচৌধুরি বলেন, ‘‘কুলভূষণের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও সমস্যা নেই৷ ভিয়েনা কনভেনশন চুক্তি (ভিসিসিআর) অনুযায়ী, তাঁর নিজস্ব কিছু অধিকার রয়েছে৷ আন্তর্জাতিক আদালতের কোনও দেশকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই৷ ফলে এখন পাকিস্তান যদি তাদের রায় না মানে, তবে কিছুই করার নেই৷ অতীতের কতগুলি ঘটনার মতো পাকিস্তানের মতো দেশ কুলভূষণকে একতরফাভাবে ফাঁসি দিয়ে দেবে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই৷ কারণ সে দেশে মানবাধিকার বলে কিছুই নেই৷ ওকে মেরে ফেলে আত্মহত্যা করেছে বলে দেওয়া হতে পারে৷ এর একমাত্র সমাধান ভারতকে আরও শক্তিশালী হতে হবে৷’’
যাদবকে নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মুখ পুড়েছে পাকিস্তানের৷ কিন্তু তাতেও হম্বিতম্বি কমছে না৷ মুখ খুলেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ৷ তাঁর কথায়, ‘‘আজমল কাসাভের চেয়েও বড় জঙ্গি কুলভূষণ৷’’ কুলভূষণকে নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলছে৷ আন্তর্জাতিক আদালত নয়াদিল্লিকে স্বস্তি দিয়েছে৷ পাক সামরিক আদালতের রায়ের উপর স্থগিতাদেশের পাশাপাশি, ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে যাদবের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত৷
এদিকে, হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায় শুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, ‘‘এই নির্দেশ কুলভূষণের পরিবারকে বিরাট স্বস্তি দিয়েছে৷’’ ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগি জানিয়েছেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তে পাকিস্তান পুরোপুরি ব্যাকফুটে৷’’ তাঁর আশা, ‘‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও ভারতের পক্ষে যাবে৷’’ সূত্রের খবর, এই মামলায় যেভাবে আইনজীবী হরিশ সালভে ও তাঁর টিম লড়ে ভারতের পক্ষে জয় কার্যত ছিনিয়ে এনেছেন, তাতে খুশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ আদালতের নির্দেশের পরই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গিয়েছে৷
অন্যদিকে, সম্প্রতি আজান বিতর্কে সোনু নিগমের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে শিরোনামে এসেছিলেন স্বঘোষিত মুসলিম ধর্মগুরু সৈয়দ শাহ আতেফ আলি আল কাদরি৷ এবার ফের ফতোয়া জারি করলেন তিনি৷ এবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে ফতোয়া৷ তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি শরিফের গলায় কুলভূষণ যাদবের জুতোর মালা পরিয়ে ভারতে ঘোরাতে পারবে, তাঁকে ২০ লক্ষ টাকা ইনাম দেওয়া হবে৷’’
ভারত-পাক সম্পর্কের অবনতি হলে বরাবরই তার প্রভাব পড়ে ক্রীড়া জগতেও৷ এবারও তার অন্যথা হয়নি৷আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে খুশি জাহির করায় পাক বাসিন্দার রোষানলে পড়তে হয়েছে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফকে৷ তবে, বাইশ গজের মতোই টুইটারেও যোগ্য জবাব দিয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার৷
আইসিজে-র রায়কে স্বাগত জানিয়েই টুইট করেছিলেন কাইফ৷ লিখেছিলেন, ‘‘এটা আসলে ন্যায়ের জয়৷’’ কাইফের এই টুইটেই যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে আমির আকরাম নামে এক পাক নাগরিক৷ প্রাক্তন ক্রিকেটারকে তাঁর নাম থেকে ‘মোহাম্মদ’ সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি৷ চওড়া ব্যাটেই পাক বাসিন্দার এই ভাষার উত্তর দেন কাইফ৷ তিনি লেখেন, ‘‘আচ্ছা! ভারতের জয়কে সমর্থন করলে আমায় নাম পাল্টাতে হবে! আমি আমার নাম নিয়ে গর্বিত৷'' এরপর ওই পাক নাগরিকের নাম নিয়েও সমালোচনা করে কাইফ লেখেন, ‘‘আমির শব্দের অর্থ তো জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ৷’’ উল্টে তাঁর দাবি, ওই ব্যক্তিরই বরং নাম বদলানো দরকার৷
কম যাননি বীরেন্দ্র শেহবাগও৷ কুলভূষণ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় যখন ফারহান জাহুর নামে পাক বাসিন্দার বাউন্সার তাঁর সামনে আসে৷ একেবারে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সে বল সোজা মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ বীরুর ভাষায় – ‘‘সারমেয় পুষতে পারেন, বিড়াল পুষতে পারেন, ভুল ধারণা পুষবেন না৷’’