কলকাতার চীনেপাড়ার মুখে কুলুপ
২৬ জুন ২০২০শুক্রবার বিকেলে, অর্থাৎ সপ্তাহান্তের শুরুতে মধ্য কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলের বিস্তৃত চায়না টাউনের যে জমজমাট চেহারা থাকে, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। কারণ, এই এলাকার সম্প্রসারিত করোনা লকডাউন, যা স্বেচ্ছায় পালন করছেন এখানকার চীনে রেস্তোরাঁর মালিকেরা। লকডাউনের বিধি মেনে আড়াই মাস টানা বন্ধ থাকার পর চলতি জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে কলকাতা শহরের রেস্তোরাঁগুলো খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ভিড় হচ্ছে না কোথাওই। লোকে যেতে ভয় পাচ্ছেন। সেখানে চায়না টাউনের রেস্তোরাঁয় যাওয়ার প্রশ্নই নেই, কারণ করোনা রোগটির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে চীন দেশটির নাম। সম্ভবত সেই কারণেই জুনের শেষ শুক্রবারেও খোলা নেই একটিও রেস্তোরাঁ। যে চীনা পরিবারগুলো এই সব রেস্তোরাঁ চালায়, তাদেরও কাউকে ধারেকাছে দেখা গেল না। জিজ্ঞেস করা গেল না, কবে আবার সব খুলবে। এবং এই স্বেচ্ছা লকডাউনই কলকাতার চীনাদের এক বড় অস্বস্তি এড়িয়ে যেতে সাহায্য করছে। লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে ভারতের চলতি বিরোধকে তাঁরা কীভাবে দেখছেন?
অবশ্য ওঁদের কাউকে হাতের কাছে পাওয়া গেলেও এই অপ্রিয় প্রসঙ্গ ওঁরা নিশ্চিতভাবে এড়িয়ে যেতেন। কারণ এর আগে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং ভারতের হারের পরিণতি কলকাতার চীনাদের পক্ষে সুবিধের হয়নি। বরং ওই যুদ্ধ এক চিরস্থায়ী বৈরিতার জন্ম দিয়েছিল। শুধু কলকাতা নয়, ভারতের কোথাও চীনাদের তার পর থেকে আর বিশ্বাস করা হয়নি, যার পরিণতিতে দেশের সেনাবাহিনীতে তো নয়ই, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনেও কখনও কোনও চীনা যুবক চাকরি পাননি। দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাস জন্ম দিয়েছে বিরাগের। প্রায় ৯০ শতাংশ চীনা যুবক-যুবতী চলে গেছেন এই শহর, এই দেশ ছেড়ে। অধিকাংশই অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডায়, যেখানে অভিবাসনের সুযোগ ছিল। যাঁরা থেকে গেছেন, প্রায় সবারই বয়স ষাটের ওপরে।
এই প্রবণতার উলটো স্রোতে ভেসেছেন বছর তিরিশেকের চীনা যুবক রবার্ট। পুরো পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক রবার্ট পেশাগতভাবে ভারতের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর বাবা, মা এবং এক ভাই কলকাতার চায়না টাউনেই থাকেন। কিন্তু কেউই সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। রবার্টও অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে, হিন্দি এবং ইংরেজি মিশিয়ে যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো: ‘‘হালকা টেনশন তো আছেই। যদিও এই সময় (অপ্রীতিকর) কিছু হয়নি। মানে, যার থেকে বলা যায় (উত্তেজনা আছে)। কিন্তু যতবার এরকম হয়... মানে দেখুন, এখানে যে চীনেরা আছেন, বা ধরুন যে ভারতীয়রা চীনে থাকেন, (তাদের) কিছু তো টেনশন হবেই। হ্যাঁ, ১৯৬২-র ঘটনা বৈরিতা মনে পড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু সেটা বয়স্ক মানুষদের। তবে আমার মনে হয়, দু'দেশের সরকারপ্রধানই যথেষ্ট বিচক্ষণ। কাজেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অবশ্য আপাতত কোনও উত্তেজনা নেই। কারও মন অস্থির থাকবে হয়ত, কিন্তু (চীনারা) কেউ সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইবে না। এই (বিরোধের) বিষয়টা নিয়ে।''
কাজেই করোনা সংক্রমণ, সীমান্ত বিরোধ, সবকিছুর মুখেই কার্যত দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে কলকাতার চীনে পাড়া। অস্বস্তি আছে হয়ত কোথাও, কিন্তু সেটা ওঁরা প্রকাশ করতে চান না। বরং আশায় আছেন, সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।