করোনায় ঢাকাছাড়া ৫০ হাজার ভাড়াটিয়া
২২ জুন ২০২০ঢাকার দক্ষিণ খান এলাকার কে সি মেমোরিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে আইটি প্রধান হিসেবে চাকরি করেন নূর হোসেন৷ থাকতেন ওই এলাকারই এক বাসায়৷ ভাড়া দিতেন ৯ হাজার টাকা৷ আর মাসে বেতন পেতেন ১৬ হাজার টাকা৷ সঙ্গে আইটির কাজ করে বাড়তি কিছু উপার্জনও হত৷ স্ত্রী আর এক সন্তান নিয়ে তার সংসার৷ কিন্তু করোনা শুরুর পর বেতন কমিয়ে ৬৫ ভাগ দেয়া হয়৷ তাই তার পক্ষে আর বাসা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় থাকা সম্ভব হয়নি৷ এক মাস আগে তিনি বাসা ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সাতক্ষীরা সদরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান৷ নূর হোসেন বলেন, ‘‘গ্রামে আসার সময় পুরো ভাড়ার টাকা দিয়ে আসতে পারিনি৷ আরো ঢাকায় থাকলে আমার পক্ষে ভাড়া দেয়া সম্ভব হতো না৷''
আইটির লোক হওয়ায় তিনি এখনো কিছু বেতন পাচ্ছেন৷ গ্রামের বাড়িতে থেকেই কিছু কাজকর্ম করে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের৷ তবে সামনে আর বেতন পাবেন কিনা নিশ্চয়তা নেই৷ ২০১৩ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন৷ করোনার কারণে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে৷ আর ফিরতে পারবেন কিনা জানেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘শুধু আমি একা নই, আমার সহকর্মীদের অনেকই টিকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছেন৷''
‘‘এই শহর আমার হলো না''
ঢাকার মালিবাগে শহিদুর রহমানের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিলো৷ চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতেন৷ শিক্ষক ছিলেন ১০ জন৷ আর ছাত্র ১৫০ জন৷ ক্লাস না চললেও এপ্রিল পর্যন্ত তিনি স্কুলটি টিকিয়ে রেখেছিলেন৷ কিন্তু এরপর আর পারেননি৷ স্কুলের ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন তার পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলনা৷ মে মাসে স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন৷ আর নিজেও জুনের ১০ তারিখ ঢাকা ছেড়ে সপরিবারে গ্রামের বাড়ি চলে যান৷ তিনি জানান, ‘‘আমি আর ঢাকা ফিরবোনা৷ অনলাইন মার্কেটিং-এর কাজ জানি৷ আমার সাতক্ষীরা শহরে বসে সেটা নিয়েই কিছু করার চেষ্টা করছি৷ ঢাকা আমার শহর নয়৷ আমার শহর হয়নি৷ আমার হবেনা৷''
ঢাকার হাজারীবাগে থাকেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার মালিক আজাদ চৌধুরী৷ তিনি যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেই ফ্লাটের দুইটি পরিবার বাসা ছেড়ে গ্রামের বড়িতে চলে গেছে গত মাসে৷ আশপাশ থেকে আরো সাত-আটটি পরিবার চলে গেছে৷ তিনি জানান, ‘‘যারা চলে গেছেন তারা ছোটখাটো চাকরি বা ব্যবসা করতেন৷ মাসিক আয় ছিলো ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ কিন্তু তাদের ব্যবসা বা চাকরি টিকে নাই৷ ঢাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে তাদের পক্ষে আর থাকা সম্ভব ছিলনা৷ এতদিন আশায় ছিলেন যে হয়তো করোনা চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷''
ঘরের জিনিস বিক্রি করে ভাড়া দিচ্ছেন:
ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, এপর্যন্ত ঢাকার ৫০ হাজার ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে৷ আর তার চেয়ে আরো অনেক বেশি মানুষ আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেন বা ওঠার চেষ্টা করছেন৷ যারা ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন তারা এখন আট-নয় হাজার টাকার ভাড়া বাসা খুঁজছেন৷ আর যাদের মাসে আয় ছিলো ২৫-৩০ হাজার টাকা তারা আর এই শহরে টিকতে পারছেন না৷
ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার অশঙ্কা করছি৷ যারা ঢাকা ছেড়েছেন তারা চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসা হারিয়েছেন৷ আরো অনেকে হারাচ্ছেন৷ তাই আমরা দাবি করেছি এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাস যাদের সামর্থ্য নেই তাদের বাড়ি ভাড়া যে-কোনো উপায়ে মওকুফ করে দেয়া হোক৷ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল ও হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করা হোক৷''
ঢাকার বস্তিবাসীদের অবস্থাও খারাপ৷ তারাও কাজ হারিয়ে ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছাড়ছেন৷ অনেককে ভাড়ার জন্য মারধরেরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷ আবার কেউ ঘরের আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য জিনিস বিক্রি করেও ভাড়া শোধ করে চলে যাচ্ছেন৷
চাকরি আছে বেতন নাই:
করোনায় অভ্যন্তরীণ অভিবাসন নিয়ে একটি গবেষণা জরিপের কাজ করছে ব্র্যাক৷ কাজ এখনও মাঝপথে থাকলেও তারা যেসব তথ্য পাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ ঢাকা ছেড়েছেন৷ তাদের অবস্থা হচ্ছে ‘চাকরি আছে বেতন নাই অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে৷'
সিপিডি ও ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, এরইমধ্যে সারাদেশে কম করে হলেও আরো নতুন করে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে নেমে গেছে৷ যারা আগে নিম্নমধ্যবিত্ত ছিলেন৷ ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন৷ তাদের একটি বড় অংশের বসবাস ঢাকা শহরে৷
তবে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার শুরুর দিকে দিনমজুর ও রিকশাচালকদের যে খারাপ অবস্থা হয়েছিলো তার উন্নতি হচ্ছে৷ শ্রমিকরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে উপার্জন করতে পেরেছে৷ এখন আবার তারা কিছু কাজ পাচ্ছে৷ কিন্তু পোশাক শ্রমিদের কাজ হারানো বাড়ছে৷ তারা গ্রামে চলে যাচ্ছেন৷ নন-এমপিও শিক্ষকরা কোনো বেতন পাচ্ছেন না৷ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বড় একটি অংশ কষ্টে আছেন৷ মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম, খাদেমরাও ভালো নাই৷
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোরশেদ বলেন, ‘‘শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে৷ তবে তাদের মধ্যে একটি অংশ অস্থির৷ তারা গ্রামে যান আবার শহরে ফিরে আসেন৷ আবার গ্রামে চলে যান৷ তাদের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নাই৷ প্রতিষ্ঠান চালু হলে যদি আবার কাজ শুরু হয় তখন বেতন পাবেন এই আশায়৷''