করোনা যেভাবে শ্রম অভিবাসনে প্রভাব ফেলেছে
৩ জুলাই ২০২২১৪ বছর আগে কাজের ভিসা নিয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমান কুমিল্লার আবুল বাসার৷ প্রথমে রিয়াদ, তারপর জেদ্দায় বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে এখন তিনি চাকরি করেন দেশটির আল কাসিম প্রদেশের একটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টে৷
বেতন হিসেবে যে দুই হাজার সৌদি রিয়াল তিনি পান তার প্রায় ৯০ শতাংশই বাড়িতে চার সদস্যের পরিবারের খরচের জন্য পাঠিয়ে দেন৷ বাড়তি আয়-রোজগার করে সৌদিতে নিজের ভরণপোষণ আর কিছু অর্থ সাশ্রয়ের চেষ্টা করেন৷
বিশ্বের ২৬ কোটি অভিবাসীর একজন এই আবুল বাসার যাদের উপার্জাত অর্থ স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে৷ এই অভিবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকেই দক্ষিণ, পূর্ব বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের৷ উপসাগরীয় দেশগুলোর ৪১ শতাংশ শ্রমিকেরই যোগান দেন এই অভিবাসীরা৷ আর ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ২০ শতাংশ৷ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো বিশ্বের অভিবাসী শ্রমিক ও প্রবাসী আয়ের মূল উৎস৷
প্রবাসী আয়: অর্থনীতির চালিকা
রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দিয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা শুধু নিজেদের পরিবার নয় দেশের অর্থনীতিকেও চাপমুক্ত রাখেন৷ জিম্বাবোয়ে, জর্জিয়া, নিকারাগুয়া এবং সেনেগালে প্রবাসী আয়ের অবদান জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশের বেশি৷ এল সালভাদর, গাম্বিয়া, জামাইকা এবং নেপালের ক্ষেত্রে তা ২০ শতাংশের বেশি৷ কিরগিজস্তান এবং তাজিকিস্তানের জাতীয় আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশেরই যোগান আসে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা থেকে৷ অঞ্চলভিত্তিতে উত্তর ও সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলো, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং মধ্য অ্যামেরিকা দেশগুলো প্রবাসী আয়ের মূল সুবিধাভোগী৷
তবে কোভিড-১৯ মহামারিতে অর্থনীতির এই ব্যবস্থায় বিপত্তি ঘটে৷ ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনা মহামারির শুরুর পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংক সে বছর প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার বা ২০ শতাংশ রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে৷
অবশ্য শুরুতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমলেও দ্রুতই তা আবার আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করে৷ ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা এবং তুরস্কের মতো কিছু দেশ রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ধাক্কা সামলাতে ডলার, ইউরোর বিপরীতে নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে৷ আবার চাকরি হারানো সত্ত্বেও পরিবারকে সহযোগিতা করতে নিজেদের জমা অর্থ পাঠাতে থাকেন প্রবাসীরা৷
যেমন, করোনার দুই বছরে জমানো টাকা ভেঙে আবুল বাসার পরিবারের অতিরিক্ত খরচ মেটানোর টাকা পাঠিয়েছেন৷ ৩৫ বছর বয়সি বাসার বলেন, ‘‘বছরে বাংলাদেশে পরিবারের কাছে আমি প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো পাঠাই৷ কিন্তু ২০২১ সালে আমার বাবা কোভিড আক্রান্ত হন৷ তার চিকিৎসা খরচেই যায় প্রায় এক লাখ টাকা৷ গত বছর তাই ছয় লাখ টাকার উপরে পাঠাতে হয়েছে দেশে৷’’
স্থানীয়দের তুলনায় কর্মসংস্থানে পিছিয়ে অভিবাসীরা
কোভিড মহামারির সময় বিভিন্ন দেশে অভিবাসীরা কর্মসংস্থান নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েন৷ বিশেষ করে মৌসুমি আর অভিবাসী শ্রমিকরা দ্রুত চাকরি হারান৷ বিভিন্ন দেশে স্থানীয় মানুষও চাকরি হারাতে থাকেন৷তবে পরিসংখ্যান বলছে, এক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকরা বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন৷ হাঙেরি, স্পেন এবং ইটালিতে স্থানীয়দের তুলনায় অভিবাসীরা ৫০ শতাংশ বেশি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন৷
অনিশ্চিত এবং কম মজুরির খাতগুলোতে অভিবাসীরা নিয়োজিত থাকায় তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি ছিল বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও৷ করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এমন খাতের মধ্যে রয়েছে খাদ্য সরবরাহ, পর্যটন, বিনোদন, খুচরা বিক্রি এবং নির্মাণ শিল্প৷
এক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকে চাকরি হারিয়ে নিজ দেশে ফেরত যান, যারা পরিসংখ্যানের আওতায় আসেননি৷ মহামারির সময় শুধু ভারতেরই ৬১ লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত আসার পরিস্থিতিতে পড়েন৷ থাইল্যান্ড, নেপাল, মালয়েশিয়া, শ্রিলংকার লাখো অভিবাসীও এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন৷ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত শ্রমিকেরা৷
তবে এই অভিবাসীরা সবাই তাদের দেশে ফেরত এসেছেন কি না এবং পরবর্তীতে কাজ ফিরে পেয়েছেন কি না তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই৷ এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের লকডাউন নীতিও অভিবাসন পরিস্থিতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে৷
সৌদি আরবে ‘সৌদিকরণ’
২০১৮ সাল থেকে সৌদি সরকার কর্মসংস্থানে নিজ দেশের মানুষদের সংখ্যা বাড়াতে নতুন নীতি বাস্তবায়ন শুরু করে৷ বিভিন্ন খাতে সৌদিদের অংশগ্রহণ বাড়াতে তাদের কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়৷ প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তার জন্য রাখা হয় জরিমানার বিধান৷ ফেয়ার স্কয়ার প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থার উদাহরণস্বপ দেখায়, সৌদির স্বাস্থ্যখাতে স্থানীয়দের কোটা পূরণের হার ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ৷
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘যেসব প্রতিষ্ঠান কোটা পূরণ করে তাদেরকে বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়, অন্যদিকে যারা কোটার নীচে অবস্থান করে বিদেশি কর্মী নিয়োগে তাদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়৷’’
সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের খবরও অভিবাসীদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করে৷ অনেক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অভিবাসীরা কোভিড আক্রান্তের হার বাড়িয়ে দিয়েছেন৷
সৌদি সরকারের বিধিনিষেধের প্রেক্ষিতে দেশটিতে নতুন অভিবাসী কর্মী নিয়োগ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়৷ যেমন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের সংখ্যা দুই তৃতীয়াংশ কমে গেছে৷ যদিও ২০২১ সাল থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করে৷
ব্যতিক্রম বাংলাদেশ
কোভিডের মধ্যেও টানা তিন বছর বাংলাদেশে রেকর্ড বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷ সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২২০০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে৷ ২০২০ সালে ২১৭৫ কোটি ডলার ও ২০১৯ সালে ১৮৩৫ কোটি ডলার পাঠান তারা৷
মহামারির মধ্যেও দেশে এত রেমিট্যান্স আসার দুইটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন৷
তিনি বলেন, একটি সাধারণ ধারণা হলো, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক পথে যত রেমিট্যান্স আসে প্রবাসীরা তার সমপরিমাণ টাকা পাঠান হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক উপায়গুলো ব্যবহার করে৷ যার কারণে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ১৫০০-১৬০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসলেও প্রকৃতপক্ষে তার পরিমাণ ৩২০০ কোটি ডলার হবে৷ কিন্তু করোনার কারণে যাতায়াত নিষেধাজ্ঞায় অনানুষ্ঠানিক পথগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়৷ এতে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর মতো আনুষ্ঠানিক খাতগুলো ব্যবহার করে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে বাধ্য হন৷
দ্বিতীয়ত, চাকরি হারানোর শঙ্কায় এবং দেশে ফিরতে হওয়ায় অনেকে নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে টাকা পাঠান পরিবার ও দেশের কাছে৷ এই দুই কারণে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে বলে মনে করেনি তিনি৷
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, কোভিডের বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অনানুষ্ঠানিক খাতে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ কমতে থাকবে৷
বিশ্ব ব্যাংকের মে মাসে প্রকাশিত মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপম্যান্ট ব্রিফ প্রতিবেদনেও এই চিত্র উঠে এসেছে৷ তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর বাংলাদেশে প্রবাসী আয় মাত্র দুই শতাংশ বাড়বে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যানেও সেই ইঙ্গিতই মিলছে৷ ঈদের কারণে মার্চে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ বাড়লেও এর আগে টানা আট মাস ধারাবাহিক প্রবাসী আয় কমছে বলে বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে৷
মাইকেল পেঙ্কে, ফয়সাল শোভন
মে মাসের ছবিঘরটি দেখুন...