নিরাপদ অভিবাসন এখনো বড় চ্যালেঞ্জ
১৮ ডিসেম্বর ২০২১আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন অনেকে৷ অনিরাপদ উপায়ে অভিবাসনে এমনকি প্রাণ হারাচ্ছেন কেউ কেউ৷ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকরা৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপদ অভিবাসনই এখন বড় চ্যালেঞ্জ৷
রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন কোটি প্রবাসী
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এক কোটি ৩৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন৷ এরমধ্যে কতজন দেশে ফিরেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে বিভিন্নভাবে এখন কর্মরত রয়েছেন এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি৷ সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে সৌদি আরবে৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৩৩০ জন গেছেন৷ এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৩ লাখ ৮৬ হাজার ৯০৩ জন, ওমানে ১৫ লাখ ৬২ হাজার, মালয়েশিয়ায় ১০ লাখ ৫৭ হাজার, সিঙ্গাপুরে ৮ লাখ ১৪ হাজার, কুয়েতে ৬ লাখ ৩১ হাজার মানুষ গেছেন৷ এটি গত নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব৷
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, জনশক্তি রপ্তানির এখনও সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য৷ বন্ধ থাকার পর অবশেষে খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার৷ ইউরোপের দেশগুলোতে সরকার নজর দিলেও শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি৷
বিদেশ কষ্টার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রবাসীরা৷ তাদের সেই অর্থে চাঙ্গা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ অভিবাসন খাত বিশ্লেষক অধ্যাপক সি আর আবরার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার তারা প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দিচ্ছেন৷ সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য এটা একটা বড় ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে তারা নিয়ে এসেছেন৷ প্রতি বছর যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন তারা যদি দেশে থাকতেন তাহলে রাষ্ট্রকে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হতো৷ সে দিক থেকেও তারা রাষ্ট্রকে নিষ্কৃতি দিচ্ছেন৷ সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, তারা বড় ধরনের ভূমিকা রাখছেন৷ অনেকে গার্মেন্টসের কথা বলেন, কিন্তু গার্মেন্টসের উপকরণ আমদানি করতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়৷ সেদিক থেকে এখানে কোন খরচ নেই৷’’
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সারা পৃথিবী বাংলাদেশকে যে ঋণ দেয় তার আট থেকে ১০ গুন টাকা প্রবাসীরা পাঠান৷ আজকে যে বাংলাদেশ ঋণ নির্ভর দেশ না, সেটা প্রবাসীদের কারণে সম্ভব হয়েছে৷ আমাদের রিজার্ভ যে ৪৩-৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে সেটাও তাদের কল্যানে৷’’
ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন
দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরও তাদের বিদেশ যাত্রার প্রক্রিয়া নিরাপদ করা যায়নি৷ চলতি বছরও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনে অনেক বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন৷ যেমন, জুলাইতে টিউনিশিয়ার কাছে সাগরে নৌকাডুবে প্রাণ হারিয়েছে ১৭ জন বাংলাদেশি। গত জুলাইতে ইউএনএইচসিআর এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম ছয়মাসে অবৈধ উপায়ে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায়ও শীর্ষে ছিল বাংলাদেশিরা৷
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘‘এখানেই একটা বড় সমস্যা৷ প্রতি বছরই আমরা দেখছি, অভিবাসীরা একটা বড় রকমের সমস্যার মধ্যে পড়ছেন৷ প্রথমত, তারা যেখানে যাচ্ছেন সেখানে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে৷ পাশাপাশি অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে ব্যয়বহুল রাষ্ট্র৷ সেটাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায়নি৷ এখানে অনেকেই দালালদের দোষারোপ করে থাকেন৷ কিন্তু দালালদের সঙ্গে রেজিষ্ট্রার্ড রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সম্পর্ক রয়েছে, ফলে দালালদের যে আইনী কাঠামোর মধ্যে আনা দরকার সেটা শুরু হয়েছে কিন্তু এখনও সম্পন্ন হয়নি৷ বিদেশে থাকার কারণে তাদের যে সেবার প্রয়োজন ছিল, সেটা একেবারেই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য৷ আমাদের দূতাবাসগুলোকেও এ ব্যাপারে ভূমিকা নিতে হবে৷’’
আরেকজন অভিবাসন খাত বিশ্লেষক আসিফ মুনির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৪০-৪৫ বছর ধরে অভিবাসন চলছে৷ আমরা আংশিক অর্জন করেছি৷ আইনী প্রক্রিয়া কিছু হয়েছে এবং সেগুলো প্রয়োগের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ এটা কার্যকরী করতে কিছু সময় লগবে৷ আইন না মেনে অভিবাসন তো আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, সেটা থেকে বের হতে তো আমাদের কিছু সময় লেগেছে৷ এখানে যে মধ্যসত্ত্বভোগী আছে তাদের অনেক সময় আইনী কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হচ্ছে না৷ এখনও আমাদের অনেক কাজ বাকী আছে সেগুলো করতে হবে৷’’
তবে সরকার অভিবাসীদের স্বার্থকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখে কীনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে৷ অভিবাসন খাত বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন কর্মী যখন বিদেশ থেকে আসেন বিমানবন্দরে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না৷ একজন শ্রমিক হিসেবে তাকে দেখা হয়৷ একই সঙ্গে তাদের যখন বিদেশে পাঠানো হয়, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়৷ এক কাজের পরিবর্তে আরেক কাজ দেওয়া হয়৷ ওই সব দেশে যে মিশনগুলো আছে তারা শ্রমিকদের সহযোগিতা করে না৷ ফলে শ্রমিক পাঠানো দেশ হিসেবে আমরা এখনও বলতে পারি না, আমরা অভিবাসীদের নিরাপদে সেখানে পাঠাতে পারছি৷ করোনার সময় আমরা দেখেছি, যখন সকল খাত মুখ থুবড়ে পড়ছিল তখন অভিবাসী শ্রমিকরা বেশি করে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন৷ এখন আমাদের দক্ষ কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাদের বেতন কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে৷’’
সবচেয়ে ঝুঁকিতে নারী অভিবাসীরা
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ১০ লাখ নারী৷ এখানে নারীদের অভিবাসনে কোন খরচ হয় না৷ একজন পুরুষ যে উপার্জন করেন তার কিছুটা তারা নিজেরা খরচ করেন৷ কিন্তু নারীরা যা উপর্জন করেন তার পুরোটাই তারা পাঠিয়ে দেন৷ এখন কথা হল, যে নারীরা সেখানে যাচ্ছেন তারা কিন্তু একটা নাজুক অবস্থানে থেকে যাচ্ছেন৷”
তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত পাঁচশ নারী শ্রমিক মারা গেছেন৷ তাদের অধিকাংশই আত্মহত্যা করেছেন৷ করোনার মধ্যে অনেক নারী অভিবাসী শূন্য হাতে দেশে ফিরেছেন৷ বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নারী অভিবাসনকে আমরা ততটা নিরাপদ করতে পারিনি৷ নারী অভিবাসনকে আমরা শ্রমিক হিসেবে মর্যাদাটুকুও দিতে পারিনি৷ আর যদি নৈতিকতার কথা বলি, নারী শ্রমিকদের সঙ্গে যে দাস আচরণ করা হয়, সেটাও আমরা প্রতিকার করতে পারিনি৷ কারণ আমরা তাদের যাদের কাছে পাঠাই তারা আমাদের চেয়ে আপারহ্যান্ডে থাকে৷ গত পাঁচ-ছয় বছরে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে৷ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ কাগজপত্রে কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু বাস্তবদিক থেকে আমরা খুব একটা এগুতে পারিনি৷’’
অর্থনীতিতে তাদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তারা যে উপার্জন করেন তার শতভাগই অর্থনীতিতে অবদান রাখছে৷ একজন নারী অভিবাসী মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করেন৷ তার পুরো টাকাটাই তারা পাঠিয়ে দেন৷ এখন ১০ লাখ নারী বিদেশ থেকে এই টাকা পাঠাচ্ছেন৷ ফলে অর্থনীতিতে তাদের অবদানটা পরিসংখ্যান দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাবে৷’’
নারীদের অভিবাসন কেন নিরাপদ করা যাচ্ছে না? জানতে চাইলে শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘‘নারীরা যেহেতু নাজুক অবস্থান থেকে আসে, ফলে তার এই অবস্থানের সুযোগটি নেওয়া হয়৷ এখন তারা যদি গৃহকর্মে না গিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক বা নার্স এই ধরনের কাজে যায় তাহলে তাদের ঝুঁকি অনেক কমে যায়৷ ফলে এখনও আমরা তাদের অভিবাসনটা নিরাপদ করতে পারিনি৷ ...প্রশিক্ষণ, বয়স, কাগজপত্র যেন ঠিক থাকে সেগুলো দেখতে হবে৷ পাশাপাশি ওই সব দেশে আমাদের যে দূতাবাস আছে সেখানে তাদের এই দায়িত্ব নিতে হবে৷’’
‘ছয় মাসে নয় লাখ মানুষ বিদেশে যাবে’
শনিবার অভিবাসী দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, করোনার কারণে অনেক মানুষ দেশে ফিরেছিলেন৷ তারা সবাই আবার আগের কর্মসংস্থানে ফিরছেন৷ সরকারের প্রত্যাশা, আগামী জুনের মধ্যে নয় থেকে সাড়ে নয় লাখ কর্মী বিদেশে যাবেন৷ সেই সঙ্গে বাড়বে রেমিট্যান্সের গতিও৷
মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর দুই শতাংশ প্রণোদনা দেয়৷ তা বাড়িয়ে চার শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি৷
একই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যেসব অভিবাসী কর্মী যাচ্ছেন, তাদের কয়েকগুণ বাড়তি বিমান ভাড়া গুণতে হচ্ছে৷ ভাড়া ৪০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে এক লাখেরও বেশি হয়েছে৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের কারণে ইটালি ও গ্রিসে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ ইটালি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে৷ সৌদি আরব ও আমিরাতে লোক নিয়োগ বন্ধ ছিল৷ সেসব দেশেও বর্তমানে যথেষ্ট কর্মী যাচ্ছেন৷
গত বছরের অক্টোবরের ছবিঘর দেখুন...