ওই শিশুটির মৃতদেহের সামনে মাথা নত করুন
২৫ এপ্রিল ২০২০হ্যাঁ, আপনাদের বলছি। দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া রাজনীতিবিদ। রুপোলি সেলিব্রিটি। সুখী গৃহকোণে লকডাউন-উদযাপনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা মধ্যবিত্ত। করোনা সংকটে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষতে বসা কর্পোরেট। হ্যাঁ, আপনাদের সকলকে বলছি-- একটু চুপ করুন। তাকিয়ে থাকুন ১২ বছরের আদিবাসী মেয়ে জামলো মাড়কমের নিথর শরীরটার দিকে। চিনে নিন আসল ভারতবর্ষ। হ্যাঁ, এটাই এ দেশের বাস্তব চিত্র। বাস্তবকে স্বীকার করুন।
জামলো আমার, আপনার ঘরের মেয়ে নয়। কিন্তু হতে পারতো। এই দেশ তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপে আমাদের শিশুরা লকডাউনে স্কুল বন্ধ বলে অনলাইনে ক্লাস করছে। স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে বাড়ির ভিতরেও তাদের বাবা-মায়েরা মাস্ক পরিয়ে রাখছেন। বাড়ি থেকে দুই পা দূরের বাজারেও পাঠানো হচ্ছে না তাদের। ঠিকই করছেন। আর জামলো? মাত্র ১২ বছরের হাড় গিলগিলে মেয়েটি পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। ছত্তিশগড়ের আদিবাসী পল্লি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে তেলেঙ্গানায় লঙ্কার খেতে কাজ করতে গিয়েছিল বাবা-মায়ের টানাটানির সংসারে সামান্য আলোর আমদানি করতে। লেখাপড়া তার কাছে নেহাতই বিলাসিতা। কিন্তু লকডাউন সে আশাতেও জল ঢেলে দিয়েছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বন্ধ ছিলো লঙ্কার খেত। তবু কোনও মতে একবেলা খেয়ে জীবন কাটছিল মেয়েটির। তারই মধ্যে খবর আসে, গ্রামের বাড়িতে সরকার ৫০০ টাকা আর ১২ কেজি চাল পাঠিয়েছে। দু'বেলা খাওয়ার 'লোভে' সহকর্মীদের একটি দলের সঙ্গে ১৫০ কিলোমিটার জঙ্গলের পথ পাড়ি দেয় জামলো। বড় রাস্তা দিয়ে যেতে ভয়। পাছে পুলিশ ধরে। অভুক্ত শরীরে পুলিশের ব্যাটন সইবে না যে!
গত ১৮ এপ্রিল বাড়ি থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে নিথর হয়ে যায় জামলোর শরীর। দু'বার বমি। ব্যস, তারপর আর সাড়া দেয়নি মেয়ে। প্রশাসন তাঁর দেহ উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরে প্রথমে করোনার পরীক্ষা করেছিল। রিপোর্ট নেগেটিভ। প্রশাসন বুঝতেই পারেনি হার গিলগিলে ওই শরীরে করোনা নয়, অপুষ্টি বাসা বেঁধেছে। সেটাই তার মৃত্যু কারণ। খিদে হেরে গিয়েছে রোদ-জল-জঙ্গলের ধকলের কাছে।
জামলোরা আসলে 'মরিয়া' প্রমাণ করছে, এ দেশে তাদেরও অস্তিত্ব আছে। তারাই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাদের ভারত ডিজিটাল নয়। নেতামন্ত্রীদের ভার্চুয়াল ভাষণ তাদের কানে পৌঁছয় না। তাদের ভারতে স্বাভাবিক সময়েই দু'বেলা রান্না হয় না। লকডাউন একবেলার ভাতও বন্ধ করে দিয়েছে। এটাই সেই ভারত, যেখানে অসুস্থ স্ত্রীকে কাঁধে তুলে মাইলের পর মাইল হেঁটে হাসপাতালে নিয়ে যান খাটো ধুতি খালি গায়ের স্বামী। অ্যাম্বুলেন্স তো অনেক পরের কথা, পথ চলতি গাড়িতে ওঠারও তাঁদের অধিকার নেই। অন্য ভারত যখন বিদেশে আটকে পরা নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ভাবনায় বিমান পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, রাজস্থানে আটকে থাকা ছেলেকে বিহারে ফিরিয়ে আনছেন রাজনীতিক বাবা, জামলোদের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তখন সামান্যতম ব্যবস্থাটুকুও করতে পারেন না এ দেশের সরকার বাহাদুর। প্রশাসনের কর্তারা। জামলো মরেছে, তাই অন্তত তার জীবনের দাম নির্ণয় হয়েছে। এক লাখ টাকা দেওয়া হবে পরিবারকে।
শুক্রবার সকালে পঞ্চায়েত দিবস উদযাপন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশের বিভিন্ন গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে ডিজিটাল বৈঠক করেছেন। জানিয়েছেন, ভারত যে ভাবে করোনার সঙ্গে লড়াই করছে, গোটা পৃথিবী তা নিয়ে বাহবা দিচ্ছে। পৃথিবীর বহু দেশকে ওষুধ দিয়ে, চিকিৎসার সরঞ্জাম পাঠিয়ে সাহায্য করছে ভারত। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের সঙ্গে নিরন্তর বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। চিঠির লড়াইয়ে একে অপরকে সংবিধানের পাঠ শেখাচ্ছেন। কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এই বাজারেও নিজের ক্ষমতা জাহির করে লোক ডেকে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। রুপোলি পর্দার সেলিব্রিটিরা বাড়িতে বসে বানিয়ে ফেলছেন আস্ত ছায়াছবি। ডিজিটাল ভারতকে তাঁরা শেখাচ্ছেন, করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে কী ভাবে সেল্ফ আইসোলেশন উপভোগ করতে হয়। নিজের জন্মদিনে ভারতীয় ক্রিকেটের রাজপুত্র সচিন তেন্ডুলকর সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, এটা আনন্দ করার সময় নয়, সকলে ঘরে বসে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হন।
না, সকলে ঘরে বসে থাকছেন না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ভোটের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদরা। গরিবের কাছে যত না ত্রাণ পৌঁছচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ছবি পোস্ট হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রাজনীতিবিদরা বলছেন, কী ভাবে তাঁর দল এই ভয়াবহ সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কী ভাবে এত কিছুর পরেও দেশকে সচল রেখেছে। আর আমরা? এ দেশের মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী সোশ্যাল মিডিয়ায় লকডাউনের নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। রাজনীতিতে কার পয়েন্ট বাড়ছে, কার কমছে, সেই হিসেব নিয়ে ভার্চুয়াল বিতর্ক জমজমাট। চলছে নানাবিধ ভার্চুয়াল চ্যালেঞ্জ। টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য আসরে বিশ্ব অর্থনীতির আলোচনা। করোনা থেকে বাঁচার উপায় জানাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। শেখাচ্ছেন স্যানিটাইজারের ব্যবহার।
চালিয়ে যান। এই সব কিছুই চালিয়ে যান। আপত্তি নেই। এ সব ছাড়া ভারতীয় সভ্যতা এগোবে কী করে? গণমাধ্যমে আপনারাই হেডলাইন ছিলেন, আছেন, থাকবেন। শুধু একটি বার, একটু সময়ের জন্য চুপ করুন। স্তব্ধ হয়ে যান। ১২ বছরের জামলোর ওই নিথর শরীরটার দিকে তাকান। মুহূর্তের জন্য হলেও চিনে নিন নিজের দেশটাকে। কষ্ট হলেও ওই নিথর মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজের শিশুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরুন। অহংকার, গর্ব, ক্ষমতা-- এই সব কিছু বিসর্জন দিয়ে লজ্জা পান।
হ্যাঁ, আপনাদের বলছি। দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া রাজনীতিক, রুপোলি গ্ল্যামার, ডিজিটাল মধ্যবিত্ত-- আপনাদের সকলকে বলছি। জামলোর নিথর লাশের সামনে একবার মাথা নত করুন।