এমন আবেগ তো ভারতে দেখি না
১ জুলাই ২০২২নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাটে বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে ঔৎসুক্য ছিল, কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণ বা আসুমদ্র হিমাচলজুড়ে তা নিয়ে আলোচনা, সেই মূর্তি দেখতে যাওয়ার ভয়ংকর তাগিদ একটা অংশের মানুষের মধ্যে হয়তো ছিল, কিন্তু তা বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নিয়ে আলোড়নের ধারেকাছে যায় না৷ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ওই মূর্তি নিয়ে যে ভয়ংকরভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন, তা নয়৷ তার উপর বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছিল লারসেন অ্যান্ড টুবরো৷ তারা কাস্টিংয়ের জন্য চীনা সংস্থার সহায়তা নিয়েছিল৷ তাই ‘আমরাও করে দেখাতে পারি'-র মতো মনোভাব দেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি৷
তাছাড়া ভারত দীর্ঘদিন ধরেই নিজস্ব প্রযুক্তিতে নানা ধরনের বড় বড় নির্মাণ কাজ করেছে৷ স্বাধীনতার পর রাশিয়ার সাহায্যে বোকারো ইস্পাত কারখানা হয়েছিল৷ ভাকরা নাঙ্গাল হয়েছে৷ জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, এগুলিই ভারতের মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার৷ নতুন ভারতের অভ্যুত্থানের ছবি৷ তারপর অনেকগুলি দশক পেরিয়ে এসেছে ভারত৷ এখন আর এরকম কোনো নির্মাণ দেশজুড়ে আবেগের বন্যায় মানুষকে ভাসায় না৷ সেতু থেকে শুরু করে ভবন, মূর্তি, সড়ক সবই দেশীয় প্রযুক্তিতে দেখতে ভারতের মানুষ অভ্যস্ত৷
কলকাতায় যখন হুগলি নদীর উপর সুদৃশ্য বিদ্যাসাগর সেতু তৈরি হলো, তখনো এরকম উন্মাদনার ছবি কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়নি৷ ২০ বছর ধরে কাজ চলার পর বিদ্যাসাগর সেতু উদ্বোধনের পর কিছু মানুষ দেখতে গিয়েছেন, ছবি তুলেছেন, এইমাত্র৷ অথবা ভারতে অন্যতম লম্বা রেল-রোড ব্রিজ বগিবিলের কথাই ধরা যাক৷ ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উপর পাঁচ কিলোমিটার লম্বা সেতু, যা আসাম ও অরুণাচলকে যুক্ত করছে, তা নিয়েও সেভাবে মানুষ আলোড়িত হলো কই! পাটনায় গঙ্গার উপর সেতু নিয়ে বিহার কিছুটা উদ্বেলিত ছিল, কিন্তু বাকিরা নয়৷ এমনকী ফারাক্কা যখন হয়েছিল, তখন উত্তরবঙ্গের মানুষ অসম্ভব খুশি ছিলেন কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের মানুষের খুব বেশি হেলদোল ছিল না৷
ভারতের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ, প্রায় প্রতিটি রাজ্যে মানুষের ভাষা, পোশাক, খাবার, গানবাজনা, আচার-আচরণ সবই বদলে যায়৷ এক রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় তা হয়৷ বাবার চাকরির জন্য আমি যখন প্রথম বাঁকুড়া যাই, তখন স্কুলে কিছু শিক্ষকের ভাষা বুঝতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যেত৷ বন্ধুরা বুঝিয়ে না দিলে বুঝতে পারতাম না৷ সেখানেও ডায়লেক্ট আলাদা, খাবার আলাদা, মানুষজনের অভ্যাস আলাদা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আলাদা, ফলে তাদের আবেগের বিষয়ও আলাদা হতে বাধ্য৷
বলিউড ও ক্রিকেট বাদ দিলে সেটাই হয়৷ ক্রিকেটের আবেগে, বলিউডের কোনও সিনেমা বা নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে উন্মাদনায় গোটা ভারত এক হয়ে যায়৷ ক্রিকেট মাঠের সেই ছবি আবার ফুটবল, হকি, কুস্তি, শুটিংয়ে নেই৷ খুব বড়সড় সাফল্য এলে অন্য কথা, না হলে কীই বা এসে গেল! যে নীরজ চোপড়া অলিম্পিকে জ্যাভলিন ছুঁড়ে সোনা নিয়ে এলেন, তিনি যখন দেশে ফিরলেন, তাকে দেখতে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নামেনি৷ অথচ, ১৯৮৩-র একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয় বা পরে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারত-জুড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল মানুষ৷
একসময় টিভি-তে রামায়ণ, মহাভারত দেখানো হলে রাস্তাঘাটে মানুষজন কম চোখে পড়তো৷ বেশির ভাগ মানুষের চোখ থাকতো টিভির পর্দায়৷ কিন্তু কোনো নির্মাণ নিয়ে তেমন আলোড়নের ছবি চোখে পড়ে না৷
দুর্গাপুজোর সময় বুর্জ খলিফার আদলে প্যান্ডেল দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল কলকাতার শ্রীভূমির রাস্তায়৷ কোনো নির্মাণ ঘিরে ভারতজুড়ে তেমন আলোড়নও বিশেষ হয় না৷ আর নির্মাণের সঙ্গে কোনো ধর্ম জুড়ে থাকে না৷ ধর্মের পরিধির বাইরে গিয়ে, ক্রিকেট-বলিউডের সীমানা ছাড়িয়ে কোনো সেতু, মূর্তি, সড়ক, ভবন নিয়ে মানুষ উতরোল হন না৷ হতে দেখি না অন্তত৷