এই ব্লগটি লিখতে বসার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে একটা ইমেইল পেলাম, যেখানে লেখা হয়েছে ‘জার্মানিতে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রভাব পড়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও৷ তাই আমরা চেষ্টা করেও দাম না বাড়িয়ে পারছি না৷ এখন থেকে মাসে ৫ ইউরো বেশি দেয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হল৷' ই-মেইলে এই চিঠিটা এসেছে আমার মেয়ের গানের স্কুল থেকে৷ এটা একটা উদাহরণ৷ এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বেড়েছে বাড়ি ভাড়া৷ একেবারে ১০০ ইউরো (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১১ হাজার টাকা)৷ পাশাপাশি বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে৷ বাড়ি ভাড়া, যাতায়াতের খরচ, স্কুলের বেতন এবং খাওয়া ও দৈনন্দিন খরচ শেষে আজকাল সঞ্চয় আর থাকছে না৷ গত ছয় মাসে আয়-ব্যয় প্রায় সমান সমান৷
আগে যেখানে ১০ থেকে ১৫ ইউরো হলে ব্যাগ ভর্তি বাজার করা যেতো, এখন সেখানে একই পরিমাণ বাজারে খরচ হয় ৪০ থেকে ৪৫ ইউরো৷ বেড়েছে বিমানের ভাড়াও৷ একটা উদাহরণ দেই৷ কোলন-বন বিমানবন্দর থেকে লন্ডনে যাওয়ার সর্বনিম্ন বিমান টিকেট ৭ থেকে ৯ ইউরো ছিলো৷ এখন এক বছর আগেও যদি আপনি টিকেট কাটেন ৩৫ ইউরোর নিচে পাবেন না৷
জার্মানির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বিভাগের সাম্প্রতিক তথ্য দিলেই বুঝতে পারবেন জার্মানির দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কতটা৷ তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মাখন এবং ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি, ৪৯ শতাংশ৷ আগে যেখানে ১ ইউরো খরচ করে ১ লিটার ভোজ্যতেল কেনা যেতো এখন সেই তেল কিনতে হচ্ছে রকমভেদে ২.৭৯ থেকে ৩.৯৯ ইউরোতে৷ যুদ্ধ শুরুর পর পর তেলের দাম প্রায় ৫ গুণ বেড়ে গিয়েছিল, এমনকি টাকা খরচ করেও কোথাও তেল পাওয়া যাচ্ছিল না৷ সেই সংকট মিটলেও দাম এখনও বাড়তি৷ ডিমের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ৷ মাংস এবং মাংসজাত পণ্যের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে৷ গম ও শস্যজাত পণ্যের দাম প্রায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে৷
এমনকি ২০২২ সালের আগস্ট মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বর মাসে খাবারের জন্য সাধারণ ভোক্তারা ১.৮ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানিয়েছে জার্মানির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বিভাগ ৷ তবে সবজি আর দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ততটা বাড়েনি৷ সবজি ৪ শতাংশ বেড়েছে এবং দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ২.২ শতাংশ৷
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জার্মানিতে ভোজ্যতেল এবং গমের দাম বাড়া স্বাভাবিক৷ কারণ ভোজ্য তেল এবং গমের জন্য দেশটি ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল এবং গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর৷ এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে জার্মানি৷ নিজেদের উৎপাদনের দিকে জোর দিচ্ছে৷
বাংলাদেশি সবজি, চাল, দেশি মাছ, সরিষার তেলের জন্য আমাদের ভরসা বাংলাদেশি দোকান৷ সেখানকার বিক্রেতাও জানালেন করোনায় একদফা দাম বাড়ার পর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আর এক দফা দাম বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে বেচাবিক্রিতে৷ দাম বাড়ার কারণে অনেকেই এখন আগের মত দেশি সবজি, তেল, ইলিশ মাছ কিনছেন না বলে জানান তিনি৷ এমন কি আগে যেখানে বিশেষ উৎসবগুলিতে মাছ, মাংস কেনার ধুম পড়ে যেতো, সেখানেও চিত্রটা বদলেছে৷ ছাগলের মাংস যেটা নেদারল্যান্ডস থেকে বন শহরে আসে সেটার দাম ছিল প্রতি কেজি ৬.৯৯ ইউরো, এখন তা কেজিতে ২.৫ ইউরো বেড়েছে৷ আধা লিটার সরিষার তেলের বোতলের দাম বেড়েছে এক ইউরো করে৷ চিনিগুড়া চাল কেজিতে বেড়েছে ১ ইউরো৷
আগে যেখানে ক্যাফেতে গিয়ে প্রতিদিন কফি আর কেক খাওয়া ছিলো জীবযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ সেখানেও রাশ টানতে হচ্ছে৷ কারণ বেড়েছে কফি এবং কেকের দাম৷ এমন কি মাসে ইন্টারনেটের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু ক্যাফেতে ফ্রি ওয়াইফাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷
গত বছরের শেষে জার্মানিতে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে পৌঁছেছিল৷ ১৯৯০ এর পর এটাই সর্বোচ্চ৷ জ্বালানি এবং খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার ফলে অন্যান্য সব জিনিসের দাম বেড়েছে৷ ফলে বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়৷
এবার আসি বাসা ভাড়ার ব্যাপারে৷ একজন ব্যক্তি যদি ২০২১ সালে প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ৪৫০ ইউরো খরচ করে থাকে, ২০২২ সালে তাকে দিতে হয়েছে ১২৬০ ইউরো৷ আর ছোট পরিবারের গ্যাস খরচ বছরে ১৪০০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ইউরোতে৷ যদিও এ বছরের জানুয়ারিতে এসে গ্যাসের দাম যুদ্ধের আগের বছরের চেয়েও কমেছিল৷ কিন্তু তা আবারও বাড়তে শুরু করেছে৷
কিন্তু এত সবের মধ্যেও জার্মান সরকার সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার খরচ কিছুটা বাঁচাতে গ্রীষ্মে নয় ইউরোর টিকেট চালু করেছিল৷ যে টিকেট দিয়ে গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত পুরো জার্মানিতে যাত্রীরা ট্রেনে চেপে ঘুরতে পেরেছেন৷ এছাড়া চলতি বছর দুই ধাপে চাকুরিজীবীদের প্রত্যেককে তিন হাজার ইউরো করে বোনাস দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া যাদের সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি, তাদেরও কয়েক মাস পর পর বোনাসের ব্যবস্থা আছে৷
জার্মানিতে এই যখন অবস্থা তখন দেশ থেকে মা ফোনে বলেন জানিস খাসির মাংস এখন কত কেজি? শাকের আঁটি, ছোট মাছ, ডিমের দাম বেড়েই চলেছে৷ তার একটাই প্রশ্ন: মধ্যবিত্তরাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, গরীব মানুষ কী করবে? তখন একটাই প্রশ্ন মনে আসে- আচ্ছা এসব পণ্যের জন্য বাংলাদেশ তো কারো উপর নির্ভরশীল নয়৷ তাহলে এসব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ কী!