যে প্রশ্নটি উঠছে, সেটি মৌলিক৷ প্রথমত, এআই-এর এই চমকপ্রদ ঘটনাটি বাইরে প্রকাশিত হওয়ায় একটা এথিকাল বা নৈতিক প্রশ্ন উঠেছে , প্রশ্ন উঠেছে এভাবে কি এআই কে ব্যবহার করা উচিত না উচিত নয়? তার থেকেও বড় প্রশ্ন যেটা উঠেছে তা হল এআই কি আদৌ পারে? হ্যাঁ, এআই অনেক কিছুই পারে, এই যেমন এআই পারল একজন মৃত মানুষের স্বরকে আবার ফিরিয়ে আনতে৷
শ্রদ্ধেয় এ আর রহমান যখন তৈরি করেছেন তখন ভাবা যেতেই পারে ব্যাপারটি অসাধারণ, অনবদ্য হয়েছে৷ কিন্তু তা পারল কে? না এআই , কিন্তু সেখানে মূল গায়ক তো একজন মানুষই৷ তাকে দিয়ে গাইয়েই তো কণ্ঠটি জোড়া হল,সেই মূল গায়ক কোথায়? আমি তাকে খুঁজছি৷ তিনি কোত্থাও নেই৷ তাহলে, এটি কি সঙ্গীতের ল্যাবরেটরি? যেখানে মানুষের জন্য কিছু তৈরি করবার আগে অজস্র গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়? সে প্রশ্নও যাক৷
আরো একটা প্রশ্ন তবু থেকে যায় যে, শিল্প কী তবে পেছনে হাঁটা শুরু করবে এবার? আর একটু বুঝিয়ে বলি – গানের পরিসর ধরেই যদি বলি তবে কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এনারা যদি আজ স্বমহিমায় থাকতেনও তবে কি আমরা আজও শুধু তাদের গানই শুনতাম? কিশোরকুমারের গলা ব্যবহারের জন্য কি তবে অমিতাভ বচ্চনকেই নিজের যৌবন কালের ‘শোলে' বা ‘অভিমান' এ ফিরে যেতে হবে? নাকি এখনকার ছবিতে তারাই গাইবেন? একটা গান তো শুধু কণ্ঠস্বর নয়৷ একটা গানে একটা সময় জেগে থাকে ,একটি কণ্ঠধারণ করে সময়ের দলিল৷
কারণ গানের কথা, স্বর, সুর, তার যে বিশেষত্ব তা কখোনোই সমসাময়িকতার প্রভাব মুক্ত নয়, হতে পারে না৷ আইসোলেশনে কোন গানের জন্ম হতে পারে না৷ তাকে সেই সময়কে সঙ্গে নিয়েই, তার গল্পকে জড়িয়েই গান হয়ে উঠতে হয়৷ আমরা কতজন আসলে জানি যে কোন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই সব শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠ নিয়ে আসা হয়েছে৷ এ কি শুধুই পরীক্ষা নিরীক্ষা? নাকি জরুরি প্রয়োজনীয়তা সত্যিই ছিল? আমি জানি আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে তা সম্ভব, ঠিকই৷
আসলে এআই সেটুকুই পারে যা মানুষ কল্পনা করতে পারে৷ অর্থাৎ, মানুষ কল্পনা করেছে এবং চেয়েছে যে আহা যদি এই গানটি আমার প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে শুনতে পেতাম! তার এই চাওয়া, সে যতই অকারণ অদ্ভূত হোক, এআই তা করে দেখাতে পারে৷ কিন্তু , আজও এআই ডানা ঝাপটায় মানুষেরই কল্পনার আকাশে৷ মানব কল্পনার বাইরে স্বাধীন ভাবে ওড়া কিন্তু এখনও সে শেখেনি৷ হ্যাঁ, অবশ্যই সে যেটা পারে তা হল মানব কল্পনাকে অবিকল খুব দ্রুত রূপদান করতে৷ তবে যেদিন এ আই মানুষের কল্পনাকে হারিয়ে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে, সেদিন , আমি নিশ্চিত মানুষের কল্পনাও অন্য ডানা পাবে, পাবে আরও বড় আকাশ৷ যে কথা বলছিলাম,কোন গানই কিন্তু কোন বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়৷ তার নির্মাণের পেছনে থাকে সেই সময়ের বেশ কিছু দাবি, তাই যে কোনো গানই একটি বিশেষ সময়ের কণ্ঠ৷ সেটি সেই সময়ে শ্রেষ্ঠ হলেও মানুষ কিন্তু তাকে পেছনে ফেলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়৷ তার এই যাওয়ার রাস্তায় যে নরম পলি পড়ে থাকে তাতে আঁকি বুকি কেটে তার ওপর দিয়েই স্রোতস্বিনী বয়ে চলে৷ এই বহমানতাই বাঁচিয়ে রেখেছে যে কোনো সৃষ্টিকে৷ তাই পেছনে ফিরে যাওয়া মানে কিছুটা সৃষ্টির নিয়মের বিপরীতে যাওয়া৷ রহমানের মত সৃষ্টিশীল সঙ্গীত পরিচালক কি তাই করবেন?
এই ছবিতে এই কণ্ঠ ব্যবহার কতোটা প্রয়োজনীয় আর কতোটা উন্নততম প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশলকে তুলে আনা, তা খানিক ভাবনার জায়গা তৈরি করে , এ আর রহমান আমার বন্ধু এবং ব্যক্তিগত বন্ধুতার খাতিরে আমি জানি এ আর রহমানের মত একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালকের কাছে সঙ্গীত কত পবিত্র৷ আগেও তার মিউজিকে তিনি বহু রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন এবং এও জানি তিনি কী পরিমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তার ল্যাবরেটরিতে৷ সঙ্গীত নিয়ে তার যা ভাবনা তা হয়ত অনেকেরই নেই৷ তাই তার ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে আমরা এই মুহূর্তে ভাবতে চাইব যে সেই ছবিতে এই কণ্ঠস্বরের প্রয়োজনীয়তা ছিল৷ ছিল বলেই এ আর রহমান এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন৷
একটা কথা বলি৷ একদিন গুহামানব নিজের খেয়ালেই গুহার দেওয়ালে তার সামনের দেখা প্রাণীটির প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেছিল৷ আধুনিক চিত্রকলার সেই তো শুরু, তারপর কালের নিয়মে কত উন্নত হলো প্রযুক্তি কিন্তু ভ্যান গখ রেমব্রান্ট অবনীন্দ্র রামকিঙ্কর ঘুরে হাতে আঁকা ছবি তো আজও আছে৷ এবং থাকবেও৷ উন্নত প্রযুক্তি মানুষেরই নির্মাণ৷ মানুষের জন্য৷ যদিও শুনতে পাচ্ছি হলিউডে এআই স্ক্রিপ্ট এর ব্যবহার নিয়ে ধর্মঘট করেছেন ওখানকার স্ক্রিপ্ট লেখকেরা৷ তবু আমি এখনও মানিনা যে এআই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী, তার নির্মাণ মানুষের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে৷ অনেকেই আমরা ছোটবেলায় রচনা লিখেছিলাম বিজ্ঞান- আশীর্বাদ না অভিশাপ? এআই ও আজ ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে৷ প্রয়োজন সঠিক সুচিন্তিত ব্যবহারের৷