আবেগে বেগবান বাংলাদেশের ক্রিকেট
১৮ অক্টোবর ২০২৪২০০৪ সালে মুলতান টেস্টে জিততে জিততে হেরে যাওয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ব্রায়ান চার্লস লারার দলের সঙ্গে সিরিজের প্রথম টেস্ট ড্র করা ছিল বাজিমাত। সে সময়ও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ খুব কম সময়ে শক্তিশালী টেস্ট দলে পরিণত হবে। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তির বিপক্ষে জয়ের রোমাঞ্চ বৈশ্বিক আলোরণ তুলেছিল। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার পর বাংলাদেশ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতবে বলে বিশ্বাস জন্মেছিল ক্রিকেটানুরাগীদের। অথচ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শিকি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।
যে দেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট আবেগ, ভালো লাগা ও ভালোবাসা- সে দেশ কেন বৈশ্বিক মানে উন্নীত হতে পারছে না? জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে কেন বলতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ ‘অধারাবাহিকতায় ধারাবাহিক'? এই দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হতাশ হওয়ার মতো অনেক কিছুই বেরিয়ে আসে। ক্রিকেট প্রশাসকদের দূরদর্শিতার অভাব, সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, অপ্রতুল অবকাঠামো, আঞ্চলিক ক্রিকেটকে অগ্রাধিকার না দেওয়া, মানহীন ঘরোয়া ক্রিকেট, দেশের ভেতরে নিম্ন মানের উইকেটে খেলা, ক্রিকেটারদের অল্পতে তুষ্টি এবং অপর্যাপ্ত অনুশীলনকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়। সেদিক থেকে যে কেউ বলতেই পারেন ভুলে ভরা সিস্টেমে চলছে দেশের ক্রিকেট। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-র সাবেক নির্বাচক হাবিবুল বাশার নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন,‘‘আমরা হলাম অধারাবাহিকতায় ধারাবাহিক। একটি সিরিজ খুব ভালো খেলি, পরের সিরিজে খারাপ। আমার মনে হয়, আমাদের স্কিল লেভেল আছে, শুধু মাইন্ড সেটে উন্নতি করতে হবে।''
নাজমুল হোসেন শান্তদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলায় অনীহা কাঙ্খিত উন্নতি হচ্ছে না বলে দাবি বাশারের। বাংলাদেশের ক্রিকেট তিমিরে থেকে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতকে সামনে এনেছেন, ‘‘একটি দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। ভারতের ক্রিকেটের উন্নতি হয়েছে তাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে। আইপিএল প্রতিদ্বন্দ্বিতা শিখিয়েছে, স্কিল লেভেল বেড়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে। গত ১০ বছর ধরে তারা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ সেখানে আস্তে আস্তে ভালো করছে। কারণ, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে ঢুকে গেলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে না। না খেলার অনেক অজুহাত আছে তাদের কাছে।''
নাজমুল আবেদীন ফাহিমও হাবিবুল বাশারের মতোই বলছেন, ‘‘ধারাবাহিক ভালো খেলার জন্য ভালো অবকাঠামো থাকা দরকার। আমরা মাঝে মাঝে ভালো খেলে ফেলি আমাদের আগ্রহ এবং তীব্র ইচ্ছা থেকে। সেজন্য আমরা ভালো করি। কিন্তু যে প্রক্রিয়া থাকা দরকার আন্তর্জাতিক খেলার জন্য, সে মোটিভটা থাকে না। আমাদের ভালো করার তীব্র ইচ্ছা থেকে ভালো খেলি কিছু সময়। আমাদের অবকাঠামো ভালো থাকলে ঘরোয়া ক্রিকেট আরো ভালো করতে পারতাম৷ তাহলে আমরা ওপরের দিকে আরো ধারাবাহিক হতে পারতাম। বিজয়গুলো হঠাৎ হঠাৎ হতো না। হারি বা জিতি পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা থাকতো। আমরা কখনো খুব ভালো খেলি, কখনো খুব খারাপ খেলি। এই জিনিসটা হয়তো থাকতো না।''
ভারত সফরে চরম ভরাডুবির কারণ হিসেবে মানহীন উইকেটে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার কথা বলেছিলেন ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ। এর জবাব ঢাকা থেকে দিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্লেষক ও বিসিবির বর্তমান পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের কেউই নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার চেষ্টা করেন না। ঘরোয়া ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সেট করে নিয়েছেন তারা। ফাহিম আরো বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে ‘আউট অব দ্য বক্স' চিন্তা করতে হয়। প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয়। একই কথা বলছেন বাশারও,‘‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব সময় আউট অব দ্য বক্সে খেলতে হয়। আপনি যা চাইবেন, হবে না। যেমন উইকেট বা কন্ডিশন চাইবেন, হবে না। যেমন প্রতিপক্ষ চাইবেন, হবে না। সব সময় নতুন কিছু নিয়ে আসে। নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। এজন্য যে প্র্যাকটিসটা দরকার, আউট অব দ্য বক্স প্র্যাকটিস করতে হবে। আমার মনে হয়, আমরা কঠিন প্র্যাকটিস কম করি।''
কঠিন অনুশীলনে ক্রিকেটারদের অনীহার কারণ হিসেবে সিস্টেমকে দায়ী করছেন লেজেন্ড অব রূপগঞ্জ-এর চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান বাদল, ‘‘সাকিব আল হাসানকে আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- প্র্যাকটিসে কতগুলো বল মোকাবেলা করেন? তিনি বলেছিলেন- তার জীবনে এক সেশনে সর্বোচ্চ ২০০ বল খেলেছেন নেটে। অথচ ভারতের শুভমান গিল প্রতিদিন ১৫০০ বল খেলেছে অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে ‘এ' দলে খেলার সময়। সেখানে আমাদের দেশে তিন সংস্করণে খেলা একজন ক্রিকেটার ২০০ বলের বেশি মোকাবেলা করে না। তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কী আশা করতে পারি। আসলে খেলোয়াড়দের একাগ্রতা তৈরিতে বোর্ডের পরিকল্পনা থাকতে হয়। দেশের ক্রিকেট কাঠামোতে এটা নেই।''
বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসরণ করা ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা হয়েছে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ার কারণগুলো। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই)-র সহকার সম্পাদক কুষান সরকারের মতে, ‘‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় সমস্যা ফরম্যাটগুলোকে আলাদা না করতে পারা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভারে ৭৫ থেকে ৮০ রান হচ্ছে। ৬০ রানকে ধরা হয় ভালো। বাংলাদেশ পাওয়ার প্লে-তে করছে ৩৫ থেকে ৪০ রান। একটি বা দুটি উইকেট চলে যাচ্ছে। মাহমুদউল্লাহর ফিনিশার হিসেবে স্ট্রাইকরেট ১৩০০এর ওপরে নয়। ফিনিশার হতে গেলে স্ট্রাইকরেট হতে হবে ১৭৫। মুস্তাফিজ ছাড়া বিশ্ব মানের বোলার একটিও নেই। বাংলাদেশে চারটি ছেলের নাম বলতে পারবেন যাদেরকে জাতীয় দলে রিপ্লেস করা যায়? অথচ অভিমনু চারটি সেঞ্চুরি করেও টেস্ট দলে জায়গা পায় না। ভারতের একটা ব্যাপার আছে- দেশটা বড়। ক্রিকেট খেলাটা খুব জনপ্রিয়। ফলে অনেক প্রতিভা বের হচ্ছে। বিসিসিআই কাঠামোটা সুন্দর তৈরি করেছে। ২০০০ সালে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছিল। সেটা এখন বেঙ্গালুরুতে বিশাল আকার দিয়েছে নিজস্ব জমির ওপর। বিকেএসপির দুটোর সমান। আমার মনে হয়, বিসিবি ক্রিকেট কাঠামোটা ঠিক দাঁড় করাতে পারেনি।''
নাজমুল আবেদীন ফাহিমও অপ্রতুল ক্রিকেট অবকাঠামো ও নিম্ন মানের লিগকে টেকসই ক্রিকেট উন্নয়নের অন্তরায় বলে মনে করেন, ‘‘ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যে মাঠগুলো রয়েছে, সেগুলোর একটু সংস্কার করা হলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা স্থানীয় লিগ ভালোভাবে খেলা যায়। কিছু কিছু অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা আছে। অনেক জায়গায় নেই। সেগুলোতে হাত দেওয়া- একটি পরিকল্পিত ক্রিকেট অ্যাকাডেমি করা প্রয়োজন। আসলে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। ঢাকায় ছোটখাটো কিছু অবকাঠামো আছে, যা মোটেই যথেষ্ট না। অবকাঠামোর কথা চিন্তা করা হলে আমরা খুবই সংকটের মধ্যেই আছি বলতে হয়।''
দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম আছে ৬টি- মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম, ফতুল্লা খান সাহেব ওসমান আলি স্টেডিয়াম, চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম, সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম, খুলনা শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম, রাজশাহী শাহীদ কামরুজ্জামান স্টেডিয়াম, বরিশাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম, কক্সবাজার ক্রিকেট কমপ্লেক্সকে আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে রূপ দেওয়া তেমন কঠিন কিছু না। শুধু হোটেল ও যাতায়াত সুবিধা ভালো হতে হবে। গোপালগঞ্জে শত কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হলেও খেলা হয় না। বিসিবি চাইলে সেখানে আবাসন সুবিধা গড়ে তুলে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারে। প্রাকৃতিক নৈসর্গ সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে দুটি মাঠ থাকার পরও হোস্টেল বা অ্যাকাডেমি না থাকায় ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে না। খুলনা এবং বগুড়া স্টেডিয়াম ক্যাম্প করার মতো হোস্টেল না থাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকে। অথচ সিলেট, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফতুল্লাহ, ময়মনসিংহে একটি করে অ্যাকাডেমি ভবন, ইনডোর ও জিম, সুইমিংপুলের সুবিধা রাখা হলে ক্রিকেটের কার্যক্রম ঢাকায় রাখতে হবে না। এক ফতুল্লা স্টেডিয়ামকে কমপ্লেক্সে রূপ দেওয়া গেলে আন্তর্জাতিকের পাশাপাশি বিরতিহীন ঘরোয়া লিগ করা সম্ভব। কারণ, স্টেডিয়াম কমপ্লেক্সে একটি আউটার মাঠও রয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি জেলায় ক্রিকেট খেলার মতো মাঠ থাকলেও সেগুলোকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেই বিসিবির।
ফাহিমের মতে, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার যে প্রয়োজন, সেটাই কেউ উপলব্ধি করেনি, ‘‘ঢাকার ক্রিকেটেই ফোকাস ছিল। এর বাইরেও যে ক্রিকেট হওয়ার কথা, হওয়া উচিত, সেদিকে কেউ কোনো দিন মনযোগ দেয়নি। ৫০টির মতো জেলায় অনেক বছর ধরে খেলাই হয় না। এদিকে কারো মনযোগ ছিল না। আমার মনে হয়, কিছুটা অবহেলা আছে, কেন তারা এগুলো নিয়ে কাজ করতে চায়নি, তা ভালোভাবে বুঝতে হবে। এগুলো করলে আমাদের ক্রিকেটের মানটা ভালো হতো।''
ঢাকা লিগ হলো সবচেযে শক্তিশালী। তৃতীয় বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার লিগ পর্যন্ত চারটি লিগ হয় ওয়ানডে ক্রিকেটের। শুধু অনিয়মটা বন্ধ করা গেলে লিস্ট ‘এ' বা ৫০ ওভারের লিগ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। প্রতিটি লিগের সঙ্গে প্রাক মৌসুমে একটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে থাকলে দারুণ হতো। সেক্ষেত্রে ২০ ওভারের ক্রিকেটেও ভালো করা সম্ভব ছিল। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে ভালো করতে না পারার কারণ শুধু বিপিএল। এবার থেকে সেখানে যোগ হচ্ছে জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টি। আট দলের জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াবে বলে মনে করেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় লিগের টি-টোযেন্টি হলে খেলা ভালো হবে। যেহেতু সম্পূর্ণ দেশি ক্রিকেটার খেলবে, সেহেতু, সবার সুযোগ থাকবে নিজেকে মেলে ধরার। বিসিবির অধীনে থাকা লিগগুলো নিয়মিত হলেও অনিয়মিত বিভাগ ও জেলা ক্রিকেট লিগ। জেলার ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্ব আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার। তারাও সাংগঠনিকভাবে ‘নবজাতক শিশু'। এক্ষত্রেও আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাগুলোকে কার্যকর করে ক্রিকেটের মানোন্নয়ন করার বিষয়ে বিসিবিকে উদ্যোগী হতে হবে।
বাংলাদেশে উইকেটের সমালোচনা হচ্ছে অনেক দিন। অথচ তার পরিবর্তনে উদ্যোগ নেই। আন্তর্জাতিক মানের কিউরেটর এনে রাখা যাচ্ছে না সিন্ডিকেটের কারণে। জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ইশতিয়াক আহমেদের মতে, ‘‘আমরা ঘরোয়া লিগে যে ক্রিকেট খেলি, সেখানে কোনো মানসম্পন্ন ক্রিকেট খেলা হয় না। একবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম- খুবই হতাশ হয়েছি। যে মানের খেলা দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে- আমরা এখনো ভালো খেলবো। এই মানের ক্রিকেট হলে দেশের ক্রিকেট বেশিদূর যেতে পারবে না।'' তিনি আরেকটি বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, বিসিবি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ ক্রিকেটারকে জাতীয় দলে নেওয়া হয় যুব দল থেকে। এইচপি বা ‘এ' দল বা ঘরোয়া ক্রিকেটে লম্বা সময় খেলে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। ফলে ক্রিকেটারদের পরিণতিবোধটা ঠিক গড়ে উঠে না বলে মনে করা হয়। বিসিবির সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে পাইপলাইন বলতে ছিল অনূর্ধ্ব-১৯।
ভারতের সাবেক পেস বোলার ও ধারাভাষ্যকার অতুল ওয়াসন দিল্লিতে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই। লিটন দাস, মেহেদী মিরাজ, হাসান মাহমুদ দারুণ ক্রিকেটার। শুরুটা ভালো করে তারা। আমি যেটা দেখেছি, প্রতি আক্রমণ হলে বোলার বা ব্যাটাররা ব্রেইন ফেইড হয়ে যায়। এই খেলোয়াড়দের প্রয়োজন মেন্টর কোচ, যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে শেখাতে পারে। এক-দুজন বিধ্বংসী ক্রিকেটার উঠে এলেই দেখবেন খোলনলচে পাল্টে যাবে। আমি মনে করি, ভারত সফর ভুলে গিয়ে পাকিস্তানে পাওয়া সাফল্যকে কাজে লাগালে ভালো করবে।''
জাতীয় দলের সাবেক কোচ রাসেল ডমিঙ্গো সাংবাদিকদের আড্ডায় একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসকরা তাৎক্ষণিক ফল চায়। একটি-দুটি জয়কে পুঁজি করে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় ও সমর্থকদের কাছ থেকে বাহবা কুড়াতে চান। সে কারণে দেশে খেলার সুবিধা নেওয়ার অজুতাতে স্লো ও লো উইকেটে খেলে ম্যাচ জেতে। ফলে বিদেশে বা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ভালো কন্ডিশনে খেলে কাঙ্খিত সাফল্য পায় না। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স তার প্রমাণ। ২০২৩ সালে ভারতে খেলা ওয়ানডে বিশ্বকাপে ফল বিপর্যয়ের পেছনেও ক্রিকেট প্রশাসকদের অদূরদর্শিতাই ফুটে উঠেছে। ঢাকার জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তর-এর সম্পাদক মোস্তফা মামুনের ব্যাখ্যা হলো, ‘‘প্রথম বিষয় হচ্ছে, আমাদের দক্ষতার ঘাটতি। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ও টেস্টে। ঠিক যেরকম খেলা উঁচিত বা যে রকম দক্ষতা অর্জন করা দরকার, সেটা নেই। দক্ষতা কেন অর্জিত হয় না? দক্ষতার ঘাটতিকে আমরা গুরুত্ব দেই না। টি-টোয়েন্টি খেলাটা যে বিশেষত্বের ব্যাপার, যে পরিকল্পনা থাকা দরকার, সেটা হয় না। বিপিএল দিয়ে এটা হতে পারতো। কিন্তু বিপিএল খুবই অদ্ভুতভাবে আয়োজন করা হয়। ‘ফান লিগ' বা ‘সার্কাস লিগ' হয়। ফলে এখান থেকে খুব একটা ক্রিকেটার তৈরি হয় না।''
টেস্ট ক্রিকেটে পেছনের সারিতে থাকার কারণও তুলে ধরেন মোস্তফা মামুন, ‘‘বড় দৈর্ঘ্যরে ক্রিকেট ভালো না হওয়ায় টেস্ট ক্রিকেটের মেজাজটা তৈরি হয়নি। মেজাজ তৈরির জন্য যে ধৈর্যের দরকার, সেটা নেই। কারণ টেস্ট ক্রিকেটে গ্ল্যামার নেই বলে কেউ মনযোগ দেয় না। আরেকটি ব্যাপার হলো, আমাদের এখানে ব্যক্তিপূজা গুরুত্বপূর্ণ। একজন খেলোয়াড় একশ বা দুইশ করলো ওগুলো নিয়ে মাতামতি বেশি। ওই ৫০, ১০০ রান ম্যাচ জেতালো কিনা ওই ভাবনা কম।''
জাতীয় দল নির্বাচনে সঠিক মূল্যায়ন হয় না বলে মনে করেন সাবেক ক্রিকেট সাংবাদিক মোস্তফা মামুন, ‘‘জনতুষ্টি অনুযায়ী দল নির্বাচন করা। একটা ম্যাচ জিতেছে- মানুষ লাফাচ্ছে ওটাকেই আমরা ক্যাশ করার চেষ্টা করেছি। মানুষ যেটা দেখে না, মনযোগ নেই, সেই জায়গায় আমরা মনযোগ দেই না। আমরা নিজেদের তুষ্টির জন্য দুর্বল দল, অপ্রস্তুত উইকেটে খেলেছি, যাতে একটা সাফল্য পাওয়া যায়। তথাকথিত সাফল্য দিয়ে মূল সমস্যাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছি। ক্রিকেটের উন্নতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সঠিক পরিকল্পনা করিনি। পুরো জিনিসটা ভুলের ওপর,হাওয়ার ওপর তৈরি হওয়া। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডে সত্যিকারের ক্রিকেট সংগঠক কম।'' তিনি আরো বলেন, ‘‘গত ২৫ বছর দেখলে আমাদের সেরা খেলোয়াড় সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ। এরপর অনেকে এসেছে৷ কিন্তু, তাদেরকে টপকাতে পারেনি। অর্থাৎ, আমরা সাকিবদের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার পাইনি। ফলে উন্নতিটা হয়নি। উন্নতি যে হয়নি এটাও আমরা বুঝতে পারি না। কখন বুঝতে পারি, যখন ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে বাজেভাবে হারি। তখন আমরা কিছু কথা বলি। বছরের পর বছর একই কথা বলা হয়।'' বাংলাদেশের ক্রিকেটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া না গেলে এবং সঠিক বিনিয়োগ না হলে অধারাবাহিকতায় ধারাবাহিকই থেকে যেতে পারে।