ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সম্পদের পরিমাণ কত জানেন? ১৮ হাজার সাতশ কোটি টাকা। ২০০২-০৩ সালে বিসিসিআইয়ের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১৫ কোটি টাকা। ২১ বছরের মধ্যে সম্পদের পরিমাণ দেখে চোখ কপালে উঠে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
সন্দেহ নেই, এর পিছনে আইপিএলের অবদান সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ১৪০ কোটির দেশে যারা টিভি-তে খেলা দেখেন, তাদের ৯০ শতাংশই ক্রিকেট দেখতে পছন্দ করেন। ফলে টেস্ট, একদিনের ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি সবেতেই টিভি সত্ত্ব ও বিজ্ঞাপন বাবদও বিসিসিআইয়ের আয় কম নয়। ফলে টাকার অঙ্কের হিসাবে বিসিসিআই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড। তবে শুধু এটুকু বললে পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে না। তার জন্য আরো একটু হিসাব দরকার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার থেকে বিসিসিআইয়ের সম্পদের পরিমাণ ২৮ গুণ বেশি। আর সবকটি টেস্ট ক্রিকেট খেলা দেশের কথা ধরলে ভারত বাদে বাকি সব বোর্ডের সম্পদ এক করে যা হয়, বিসিসিআইয়ের সম্পদ তার থেকেও তিনগুণ বেশি।
ফলে অর্থের নিরিখে বিসিসিআইয়ের ধারেকাছে, আশেপাশে কেউ নেই। আর আয় বাড়ার পরে বিসিসিআই যেটা করেছে, সেটা হলো ক্রিকেট পরিকাঠামোয় যেমন অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তেমনই তারা ক্রিকেটারদেরও ঢালাও অর্থ দিচ্ছে। ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে মিশে গেছে বলিউডের গ্ল্যামার, টি-টোয়েন্টি আসার পর চার-ছক্কার বা আউটের উত্তেজনা। ফলে তা আরো বেশি করে মানুষকে আকৃষ্ট করছে। একদা অভিজাতদের ফিটফাট হয়ে নান্দনিক স্ট্রোক খেলার ক্রিকেট এখন ভারতে একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আর রাজা-মহারাজারা নয়, একেবারে সাধারণ মানুষ ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে। কেউ মালির ছেলে, কেউ ভ্যানগাড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার বিলি করা বাবার ছেলে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার একটা সুযোগ বিসিসিআই করে দিচ্ছে। ফলে শুধু আয় নয়, খরচ করার বিষয়েও তারা কার্পণ্য় করছে না। তাই ক্রিকেট ঘিরে ভারতেও তৈরি হচ্ছে রূপকথা-সম গল্প। ক্রিকেটকে ঘিরে তারি হচ্ছে আবেগের বিস্ফোরণ।
ক্রিকেটাররা কত পায়?
জাতীয় দলে খেলা ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ড বাৎসরিক চুক্তি করে। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, যশপ্রীত বুমরা, রবীন্দ্র জাদেজারা আছেন এ প্লাসে, তারা বছরে সাত কোটি টাকা পান। অশ্বিন, শামি, সিরাজ, কে এল রাহুলরা পান পাঁচ কোটি টাকা। যশস্বী জয়সওয়াল, কুলদীপ যাদব, ঋষভ পন্থরা বি গ্রুপে আছেন বলে তিন কোটি টাকা পান। গ্রুপ সি ক্রিকেটাররা পান এক কোটি টাকা।
তার সঙ্গে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচের জন্য তারা ১৫ লাখ টাকা পান। এর উপরে রয়েছে ইনসেনটিভ স্কিম। একজন বেশ কিছু টেস্ট ম্যাচ খেললে তিনি টেস্ট পিছু বাড়তি ৪৫ লাখ টাকা পাবেন। একদিনের ক্রিকেট খেললে ছয় লাখ টাকা এবং টি-টোয়েন্টি খেললে প্রতি ম্যাচে তিন লাখ টাকা এবং দেড় লাখ টাকা ইনসেনটিভ।
রঞ্জি ট্রফিতে যাদের ৪১টি ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে তারা পান ম্যাচ পিছু ৬০ হাজার টাকা। রিজার্ভে থাকলে ৩০ হাজার টাকা। যারা কম ম্যাচ খেলেছেন তারা পান ৫০ হাজার, নতুনরা পান ৪০ হাজার টাকা। বিজয় হাজারে ট্রফিতেও প্লেয়াররা একই অঙ্কের টাকা পান। বোর্ডের হিসাব হলো, রঞ্জি ট্রফিতে খেলে রাজ্য দলের ভালো ক্রিকেটাররা ৭৫ লাখ টাকা বছরে আয় করেন।
শুধু টাকা নয়, এই প্রতিযোগিতার উপরে এখন বিসিসিআই প্রচুর গুরুত্ব দিচ্ছে। সব প্লেয়ারকে বলা হচ্ছে, জাতীয় টিমে ঠাঁই না পেলে রঞ্জি খেলতে হবে। সেখানে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। তাছাড়া বিসিসিআই এখন ইন্ডিয়া এ, ইন্ডিয়া বি, ইন্ডিয়া সি, ইন্ডিয়া ডি টিম গঠন করে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চালু করেছে। সেই সব টিমে ভালো পারফরমেন্স করলে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
ফলে একগুচ্ছ ভালো ক্রিকেটার উঠে এসেছে ও আসছে। প্রচুর ক্রিকেটার তাদের প্রতিভার পরিচয় দেয়ার সুয়োগ পাচ্ছে। ভারতীয় দলে এখন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরাও অপরিহার্য প্লেয়ার নন। ভালো খেলতে না পারলে, তারাও প্রবল চাপে থাকেন। কারণ, অনেক ভালো ক্রিকেটার জাতীয় দলে ঢোকার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভারতের টেস্ট দল ও টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক আলাদা। প্লেয়াররাও আলাদা। তাই অনেক বালো প্লেয়ারকে বিশ্রাম দিয়েও ভারত প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুরমুষ করতে পারছে। আবার কখনো সখনো মুখ থুবড়েও পড়ছে। তবে কথাতেই াছে, ব্যতিক্রমই প্রমাণ করে নিয়মের উপযোগিতা।
প্রশিক্ষণের সুয়োগ-সুবিধা
বেঙ্গালুরুতে বিসিসিআইয়ের যে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমি রয়েছে, সেখানে ৪০ একর জমিতে তিনটে স্টেডিয়ামে ৮৬টি আন্তর্জাতিক মানের পিচ আছে। বেশ কিছু পিচ ইন্ডোর, অন্যগুলি আউটডোর। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়াতেও প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকবে না। এই পিচগুলো বিভিন্ন ধরনের মাটি দিয়ে তৈরি। কোনোটাতে বিদেশি পিচের মতো পেস সহায়ক, কোনোটা স্পিন সহায়ক। কোথাও বাউন্স বেশি থাকে। কোথাও পাটা উইকেট থাকে। সব ধরনের পিচে খেলে নিজেদের তৈরি করতে পারেন বোলার ও ব্যাটাররা।
সব পিচে ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আছে। স্পোর্টস সায়েন্স, মেডিসিন ল্যাব, ফিজিওথেরাপির সর্বাধুনিক ব্যবস্থা আছে। সেইসঙ্গে আছে জাকুজি-সহ বিভিন্ন ধরনের শাওয়ার ও সুইমিং পুল। এছাড়া কোচ থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় স্তরে এই একাডেমির পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে ক্রিকেট একাডেমি আছে। ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে, স্কুলে-কলেজে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে।
একটা সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট শাসন করতো মুম্বই লবি। অনেকদিন হলো, মুম্বই লবির শাসন থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বেরিয়ে এসেছে। এখন দেশের সব দিক থেকে প্লেয়াররা সুযোগ পাচ্ছেন। প্রতিভা থাকলে ডাক পাচ্ছেন। নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে টিমে থেকে যেতে পারছেন। এমনও সময় ছিল, যখন গাভাস্কার এক ওভার বল করার পর তা তুলে দেয়া হতো বেদী, প্রসন্ন বা চন্দ্রশেখরের হাতে। সেই সময়ও চলে গেছে। কপিল দেবের পর থেকে ভারতে একের পর এক পেসার উঠে এসেছে। স্পিনারদের ঐতিহ্য তো আছেই। সেজন্য বড় ক্রিকেটাররা অবসর নিলেও তাদের অভাব বোঝা যায় না। একদিনের বিশ্বকাপ জেতার পর রোহিত, বিরাট সহ চারজন ক্রিকেটার একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। তারপরেও তাদের অভাব অনুভূত হয়নি। ভারতকে এখন সাবেক ক্রিকেটাররাই কোচিং করাচ্ছেন। দ্রাবিড়ের পর এখন গম্ভীর হাল ধরেছেন। সবমিলিয়ে ভারতের ক্রিকেট এখন পরিকল্পমাফিকই এগোচ্ছে।