উদ্বৃত্ত খাবারে বাঁচবে নিরন্ন দেশ
১৯ অক্টোবর ২০১৬এ যেন অনেকটা পরিচিত সেই গানের কথার মতো— ‘কেউ যদি বেশি খাও, খাওয়ার হিসেব নাও, কেন না অনেক লোক ভাল করে খায় না'। এই বৈপরিত্য, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে চিরদিনের৷ সে ভারতীয় উপমহাদেশ হোক, অথবা লাটিন আমেরিকার কোনো গরিব দেশ, কিছু লোক ফেলে–ছড়িয়ে খায়, আর কিছু লোক পেটভরে খেতে পায় না৷ হিসেব কষে দেখা গেছে, প্রতিদিন যে বিপুল পরিমান খাবার স্রেফ ফেলা হয়, তাই দিয়ে ওই নিরন্ন মানুষদের দিব্যি খাইয়েদাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়৷
কিন্তু সেটা হয় না বলেই প্রতিদিন অনাহারে মানুষ মারা যায়৷ এইডসের মতো কালান্তক ব্যাধি, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মা রোগে মোট যত মানুষ সারা বিশ্বে প্রতি বছর মারা যান, তার থেকে বেশি মারা যান অভুক্ত মানুষ৷ ভারতের ক্ষেত্রে এই না খেয়ে থাকার পরিসংখ্যানটা ভয়াবহ৷ বিশ্বে আনুমানিক ৮০ কোটি মানুষ না খেয়ে থাকেন, তার মধ্যে প্রায় ২০ কোটি থাকেন ভারতে৷
২৫ কোটি ভারতীয় আধপেটা খান৷ রাতে খালিপেটেই ঘুমোতে যান৷ ভারতের ৪৬% সদ্যোজাত শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়, কারণ গর্ভাবস্থায় তাদের মায়েরা পেটভরে খেতে পাননা৷ ভারতে প্রতি বছর ১৩ লক্ষ শিশু অপুষ্টির কারণে মারা যায়৷ পাঁচ বছরের কম বয়সি ৩৮.৭% শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় সেই অপুষ্টির কারণে৷ এই উদ্বেগজনক তথ্য–পরিসংখ্যানের অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো একটাই৷ ১৯৯০ সালের পর থেকে ভারতে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা ধীরে হলেও কমছে৷ এবং এই সাফল্যের আংশিক কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন ভারতের সেইসব স্বেচ্ছাসেবী, যাঁরা পণ করেছেন একজন মানুষকেও অভুক্ত থাকতে দেবেন না৷
২০১২ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন৷ ‘জিরো হাঙ্গার চ্যালেঞ্জ' নামে সেই কর্মসূচিতে যে পাঁচটি আবশ্যিক কাজের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো খাবার নষ্ট না করা৷ উৎপাদনের সময় থেকে শুরু করে ভোক্তার খাওয়ার টেবিলে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যেন খাবার নষ্ট না হয়৷ তার থেকেই ধারণাটা পেয়েছেন ভারতের স্বেচ্ছাসেবীরা যে, উদ্বৃত্ত খাবার সংগ্রহ করে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়৷
সমাজের নানা স্তরে, গোষ্ঠীগতভাবে এবং এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই কাজটা শুরু হয়েছে, যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে শহরে শহরে৷ চালু হয়েছে হাঙ্গার হেল্পলাইন, যেখানে ফোন করলে সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা এসে বাড়ি, বা দোকান, কিংবা রেস্তোরাঁ থেকে উদ্বৃত্ত খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে৷ মুম্বইয়ের বিখ্যাত ডাব্বাওয়ালারা, যাঁদের কাজ মুম্বই ও শহরতলীর চাকুরিজীবীদের বাড়িতে বানানো খাবার ভরা টিফিন ক্যারিয়ার বা ‘ডাব্বা' বাড়ি থেকে নিয়ে দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া, তাঁরাও শামিল হয়েছেন এই মহৎ উদ্যোগে৷
তাঁরা তৈরি করেছেন ‘রোটি ব্যাঙ্ক', যেখানে জমা পড়ে ওইসব ডাব্বার বেঁচে যাওয়া খাবার, যা নিয়মিত বিলি করা হয় বিভিন্ন এলাকার গরিব বাসিন্দা, বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে৷ এবং একজনের সচেতনতা সঞ্চারিত হচ্ছে অন্যের মধ্যে৷ নিজেদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট নয়, লোকে নিজেদের টিফিন থেকে আলাদা করে খাবার বাঁচিয়ে রাখছেন রোটি ব্যাঙ্কের জন্য৷ বাড়ির গিন্নিরা রান্নার সময় বাড়তি একটু খাবার তৈরি করে রাখছেন, যা জমা পড়বে ডাব্বাওয়ালাদের খাদ্য ভাণ্ডারে৷ এখান থেকেই ধারণাটা পেয়েছেন বেঙ্গালুরুর এক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ৷ তিনি রীতিমতো এলাকাভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছেন, যেখানে গৃহিনীদের আগে থেকে যোগাযোগ করে বলে দেওয়া হয়, কোনদিন তাঁদের এলাকায় খাবার বিতরণের কর্মসূচি৷ সবাই সেদিন আলাদাভাবে খাবার বানাচ্ছেন, যে খাবার পেট ভরাচ্ছে অভুক্ত মানুষের৷
এছাড়া আছে ‘রবিনহুড আর্মি', যারা সক্রিয় দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, কলকাতা, আসানসোলসহ দেশের ১৫টি শহরে৷ এই রবিনহুড আর্মি'র প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির নীল ঘোষ এবং আনন্দ সিনহা৷ নীল চাকরিসূত্রে পর্তুগাল গিয়ে দেখেছিলেন ‘রিফুড' বলে একটি সংগঠনের এধরনের কাজ৷ একজন মানুষ একটি সাইকেলে খাবার নিয়ে কীভাবে পর্তুগালে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন, দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন নীল৷ দেশে ফিরে তিনিও শুরু করে দেন৷ সঙ্গে পান বন্ধু আনন্দ সিনহাকে৷
এই মুহূর্তে ভারতের ১৫টি শহরে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করছে এই ‘রবিনহুড আর্মি'৷ কলকাতার প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের বাসিন্দা, পেশায় ইঞ্জিনিয়র উদয়ন বুবনা ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন দিল্লির রবিনহুড আর্মির সঙ্গে৷ কথা বলেন শহরের বেশ কিছু হোটেল, রেস্তোঁরার সঙ্গে৷ অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়৷ তারপর উদয়ন নিজের গাড়িতেই খাবার নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিলি করা শুরু করেন৷ শুরু এভাবেই হয়েছিল, এখন আরও সচেতনতা ছড়াচ্ছে, আরও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিচ্ছেন৷ এবং এখানেই শেষ নয়৷ ভারতের মতো পাকিস্তানেও ‘হামলা' চালিয়েছে রবিনহুড আর্মি৷ কারণ দু'দেশেরই তো শত্রু এক এবং অভিন্ন৷ ক্ষুধা৷ ভারত আর পাকিস্তান একজোটে লড়ছে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে৷