উজরা জেয়া যে বার্তা দিয়ে গেলেন
১৪ জুলাই ২০২৩যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নির্বাচন এবং সুশাসনে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশির অংশগ্রহণের ওপর বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে৷
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাইরে থেকে আমরা যা দেখছি, বিষয়টি এমন নাও হতে পারে৷ সাংবাদিকদের কাছে তিনি যেটা বলছেন, সেটা তো তারা অনেকদিন ধরেই বলছেন৷ এই কথা বলার জন্য তাকে সুদুর আমেরিকা থেকে ঢাকায় আসতে হতো না৷ ওখানে বসে একটা বিবৃতির মাধ্যমে বলে দিলেই পারতেন৷ উনি যেহেতু বাংলাদেশে এসেছেন নিশ্চয় কিছু বার্তা তিনি দিয়েছেন৷ সেটা হয়ত আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারছি না৷ যাদের এই বার্তা দেওয়া প্রয়োজন তাদেরই তিনি সেটা দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস৷''
তবে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, কিছু বিষয় নিয়েযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল এবং তা কমেছে৷ উজরা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর একথা বলেন তিনি৷ চার দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে বৃহস্পতিবার রাতে উজরা জেয়া ঢাকা ছাড়েন৷ তার আগে গুলশানে সালমান এফ রহমানের বাসভবনে রাত ৯টা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন তিনি৷ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুও উপস্থিত ছিলেন৷ অপর দিকে বাংলাদেশের পক্ষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন৷
বৈঠক শেষে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘‘কিছু বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল৷ সে কারণে দেশটি বাংলাদেশের ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (ব়্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দিয়েছিল৷ বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা হয়েছিল৷ তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব কমেছে৷ তারা বাংলাদেশে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ চেয়েছে৷''
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন৷ এর আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন উজরা জেয়া৷
বৃহস্পতিবার দুপুরে পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি৷ তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিনের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র তার ভূমিকা রাখতে চায়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সরকারের একাধিক মন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন৷ নির্বাচনের আগে বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সবাই সংলাপ চাই৷ তবে এই প্রক্রিয়ায় আমরা সরাসরি যুক্ত নই৷''
উজরা জেয়ার ঢাকা সফরে কী বার্তা পেল বিএনপি? জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের বার্তা তো পরিষ্কার৷ এই সরকারের উপর তাদের কোনো আস্থা নেই৷ এটা অবৈধ সরকার৷ ফলে তারা যেটা বলেছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা৷ তারা তো সেটাই বলবে৷ এখন কীভাবে এই নির্বাচন হবে সেটা আমাদের ঠিক করতে হবে৷ এদেশের জনগণ ঠিক করবে৷ এই সরকারের অধীনে যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না সেটা তো সবাই পরিষ্কার৷ ফলে আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে হবে৷ দেখেন, মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি তো নেপালে যাননি, শ্রীলংকায় যাননি, এমনকি পাকিস্তানেও যাননি৷ বাংলাদেশে এসেছেন৷ কেন এসেছেন, সবাই জানে৷ ফলে তারা কী চাচ্ছে, এটা তো পরিষ্কার৷''
তবে উজরা জেয়ার এই সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ৷ দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উজরা জেয়ার বক্তব্য তো পরিষ্কার৷ তারা তো সরকারের কার্যক্রমে খুশি হয়েছে৷ এখন তারা যে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, সেটা তো আওয়ামী লীগও বলছে৷ আমরাও চাই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক৷ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক৷ বিএনপি নির্বাচনে না এলে যে সেটা অংশগ্রহণমূলক হবে না সে কথা তারা বলেনি৷ কেউ যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তো তাদের ব্যাপার৷ আমরা সুষ্ঠু একটা নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারি৷ সেই কাজটাই আমরা করছি৷''
আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকারের বিষয়ে মনোভাব জানতে চাইলে উজরা জেয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি অন্য মন্ত্রীদের কাছ থেকে জোরালো প্রত্যয়ের কথা শুনেছি৷ পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গেও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করেছি৷''
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশ করে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে৷ তাদের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকের পাশের সড়কে সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ৷ কোনো ধরনের সংঘাত, সহিংসতা ছাড়াই গতকালের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ শেষ হয়েছে৷
এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশাল জনসভা দেখেছি৷ স্বস্তির বিষয়টি হচ্ছে, কোনোরকম সহিংসতা ছাড়াই সেটা হয়েছে৷ আমরা যেমনটা দেখতে চাই, এটা তার সূচনা৷ ভবিষ্যতেও এটির প্রতিফলন থাকবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা৷''
তবে বাইরে থেকে যা দেখা যাচ্ছে বিষয়টি এমন নাও হতে পারে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে বাইরে থেকে দেখছি, বিষয়টি আমার মনে হয় না এমন৷ মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি নিশ্চয় কোনো বার্তা দিয়ে গেছেন৷ সেটা হয়ত আমরা এখন টের পাচ্ছি না৷ সামনের সময়ে সেটা হয়ত আমরা বুঝতে পারব৷ তবে তারা যে একটা ভালো নির্বাচন চায় এটা সত্যি৷ এবং সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নিক সেটাও তাদের প্রত্যাশা৷''
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে আমেরিকান ক্লাবে দেশের নাগরিক সমাজ, শ্রমিক সংগঠন ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন উজরা৷ বৈঠকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি- বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক ও টেলিভিশন টক শো তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন এবং বেসরকারি সংস্থা সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এ কে এম নাসিম উপস্থিত ছিলেন৷
আলোচনায় বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যেসব বিতর্ক ও সমালোচনা তৈরি হয়েছে, তা যারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেবে, তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে৷ যারা একটি ভালো নির্বাচনের পক্ষে বা জন্য কাজ করছে, তাদের তো ভয়ের কিছু নেই৷''
মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘‘আমরা তাদের বলেছি, সরকারের উন্নয়ন বয়ানের বিরোধিতা করাকে অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে বলা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনাও নয়, বরং কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পের সমালোচনা করা হলেও তা সরকারের সমালোচনা হিসেবে দেখা হয়৷ কিছু কিছু বিষয়ে এ ধরনের সংবেদনশীল আচরণ দেশের অধিকারকর্মীদের কাজের পথে বাধা তৈরি করছে৷''