ইভ টিজিংয়ের শেষ কোথায়?
১১ জুলাই ২০১৭গত ৩০ জুন বিকেলে মহাখালী যাওয়ার জন্য যাত্রাবাড়ি বাস টার্মিনালে অপেক্ষা করছিলেন এক তরুণী৷ সেই সময় স্থানীয় বখাটে ফাহিম ইসলাম রাব্বি তরুণীকে উত্যক্ত করতে থাকে৷ তরুণী এড়িয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে রাব্বি মোটরসাইকেল দিয়ে গতিরোধ করে৷ এমনকি তুলে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করে৷ কিন্তু তরুণীর কপাল ভালো যে, কাছেই ছিল র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ বিষয়টি তাঁদের নজরে এলে তাঁরা তরুণীকে যৌন হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করে বখাটে রাব্বিকে আটক করে৷ এই ঘটনায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রের রাব্বিকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন৷
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কাছে ছিল বলে তরুণী রক্ষা পেয়েছেন৷ অপরাধী আটক হয়েছে, সাজা পেয়েছে৷ নয়ত ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে ‘লোক লজ্জার' ভয়ে তাঁকে হয় কোথাও পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে হতো, নইলে হয়ত জীবন থেকেই বিদায় নিতে হতো৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান তেমন আশঙ্কাই জাগায়৷
জুন মাসে মহিলা পরিষদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য ও খবরের ভিত্তিতে এক প্রতিবেদনে জানায়, গত আড়াই বছরে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে ৪০ জন আত্মহত্যা করেছেন৷ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি জুন পর্যন্ত ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭৫৪টি৷
চলতি বছরের পাঁচ মাসে ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ১০৮টি এবং সাত তরুণী আত্মহত্যা করেন৷ কেবল মে মাসেই ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ২১টি৷ এ সময়ে ইভ টিজিংয়ের শিকারদের মধ্যে দু'জন আত্মহত্যা করেন৷
মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাস পুরকায়স্থ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই হিসাব পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেয়া হয়েছে৷ তবে অনেক খবরই পত্রিকায় আসে না৷ আমরা মনে করি, প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ৷''
ইভ টিজাররা অনেক ক্ষেত্রেই বেপরোয়া৷ তারা ইভ টিজিং করেই ক্ষান্ত হয় না৷ কেউ প্রতবাদ করলে তার ওপরও হামলা করে৷
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে এর প্রতিবাদ করেন তাঁর সহপাঠি রনি ও রাহুল৷ তাঁরা প্রতিবাদ করায় ছাত্র লীগের কর্মী রাহাত ও মিরাজসহ কয়েকজন রনি ও রাহুলকে বেদম মারপিট করে৷ এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ইভ টিজারদের বিরুদ্ধে নালিশ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি৷
গত ১২ মে যশোর সদর উপজেলার মোমিননগরের নওদাগাঁয় ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় হামলার শিকার হয় রেজাউল ইসলাম রিজু নামে এক মাদ্রাসা ছাত্র৷ টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুরে ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় একজন স্কুলছাত্রীসহ পাঁচজনকে পিটিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা৷ আর ২০১৬ সালের অক্টোবরে মিরপুরে স্কুল ছাত্রী দুই যমজ বোন ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় তাদের পিটিয়ে আহত করে ইভ টিজার লুৎফর বাবু ও তার সহযোগিরা৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ পরে আরো একজনকে আটক করা হয়৷
নিজের দুই মেয়ে মার খেলেও ইভ টিজারদের প্রতিরোধ করায় তখন গর্বিত হয়েছিলেন তাদের বাবা আহসান হাবিব৷ কিন্তু এ পর্যায়ে এসে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমার গর্বের জায়গা আর নাই৷ মামলায় মামুলি একটা চার্জশিট হয়েছে৷ দুই আসামি এরই মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছে৷ আমার আইনজীবী জানিয়েছেন, যেভাবে চার্জশিট দেয়া হয়েছে তাতে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাবে৷ তাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইভ টিজিং প্রতিরোধে আইন আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন৷ আর প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা৷ এটা হচ্ছে না বলেই ইভ টিজিং কমছে না৷ বখাটেরা দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ এই দেশে কিছুই হয় না৷ আমি হতাশ৷''
ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা অনেক৷ আবার ইভ টিজারদের হাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে৷ ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ২০১৬ সালের আগস্টে ইভ টিজার ওবায়দুলের হাতে প্রাণ দিতে হয়৷ ওবায়দুল আটক হয়েছে৷ তার বিচারও শুরু হয়েছে, কিন্তু ইভ টিজারদের দৌরাত্ম কমছে না৷
মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাস পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘আমাদের ইভ টিজিং শব্দটিতে আপত্তি আছে৷ এই শব্দটি অপরাধকে হালকা করে দেয়৷ এটা আসলে যৌনসন্ত্রাস৷ আড়াই বছরে এর শিকার হয়ে ৪০ নারীর আত্মহত্যাও আমাদের টনক নাড়ায় না৷ এটাকে আমরা আত্মহত্যা বলছি কেন? এটা তো হত্যাণ্ড৷ দুর্বৃত্তরা মেয়ে বা নারীকে এমনভাবে যৌন হয়রানি বা নির্যাতন করে যে, ওই নারীর কাছে জীবনের চেয়ে মরণই শ্রেয় হয়ে যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘যৌন হয়রানির জন্য আলাদা কোনো আইন নাই৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায়ই এ ব্যাপারে মামলা হয়৷ তবে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে যৌন নিপীড়নবিরোধী একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেয়৷ তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি অফিসে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল, অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ আমরা চাই, এটা আইনে পরিণত করা হোক৷''
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্তে সারাদেশে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে, মার্কেট, শপিংমল, বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশনে ভ্রাম্যমাণ আদালত জোরদার করা হয় ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে৷ র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সরওয়ার আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট অনেক কার্যকর৷ কারণ সাধারণভাবে মামলা করে প্রতিকার পেতে অনেক সময় লাগে৷ আর মোবাইল কোর্ট তাৎক্ষণিক সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি দেয়৷ তা না হলে ইভ টিজিংয়ের শিকার নারীর সাধারণভাবে বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো আরো হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷''
এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটই ৩০ জুন যাত্রাবাড়ীতে ইভ টিজার ফাহিম ইসলাম রাবিকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভ্রাম্যমাণ আদালত না থাকলে ওই দিন ওই তরুণীর আরো বিপদ হতে পারতো৷ কারণ, সে ঢাকার বাইরে থাকে৷ তার সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না৷ সে কোথায় মামলা করত? কে তাকে সহায়তা করত? সাক্ষী কোথায় পেত?''
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরো জানান, ‘‘গত ছর ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত আট জনকে শাস্তি দিয়েছে৷ আর এ বছর পর্যন্ত দিয়েছে তিনজনকে৷''
সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শপিং সেন্টারের মতো জনবহুল জায়গায় নারীরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হন৷ যাঁরা শিকার হন, তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে৷ আর যারা এই অপরাধ করে, তাদের বয়স মোটামুটি ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷ তবে রাখী দাস পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘শিশুরাও যৌন নিপীড়ন বা হয়রানি থেকে রেহাই পান না৷ আর কর্মস্থলেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে৷''
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সরওয়ার আলম বলেন, ‘‘দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় ইভ টিজংয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল৷ ইভ টিজিং বলতে অশ্লীল শারীরিক অঙ্গভঙ্গি বা বাক্য-শব্দকে বোঝানো হয়৷ আর সেটা যদি নারীর শরীরে স্পর্শের পর্যায়ে যায়, তাহলে দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারায় বিচার হয়৷ তার সর্বোচ্চ শান্তি ২ বছরের জেল৷ পরবর্তী অপরাধের ধাপগুলোর জন্য আইনেই বলা আছে শাস্তির কথা৷''
কিন্তু আইনের চেয়ে বড় বিষয় হলো মূল্যবোধ৷ মো. সরওয়ার আলম বলেন, ‘‘আমরা আটকের পর ইভ টিজারদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তারা নারীর প্রতি যে সম্মান দেখাতে হয়, সেই শিক্ষা পরিবার থেকে পায়নি৷ আর কেউ কেউ সঙ্গীদের কারণে খারাপ পথে গেছে৷''
রাখী দাস পুরকায়স্থ মনে করেন, ‘‘নারীর প্রতি সম্মানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ৷ এই মূল্যবোধ সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়াতে না পারলে শুধু আইন দিয়ে ইভ টিজিং ঠেকানো যাবে না৷ গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন৷''
মো. সরওয়ার আলম স্পষ্ট করেই বলেছেন, অনেকে যে ইভ টিজিংয়ের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করেন, তা একেবারেই অযৌক্তিক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কেউ কেউ বলতে চান, ইভ টিজিংয়ের সঙ্গে পোশাকের একটা সম্পর্ক আছে৷ কিন্তু বাস্তবে তা নয়৷ ইভ টিজাররা পোশাক বিবেচনা করে না৷ তারা যাকে সামনে পায়, তাকেই উত্যক্ত করে৷ তাদের কাছে তথাকথিত শালীন পোশাকের মেয়েরাও রেহাই পায় না৷ এটা আসলে মূল্যবোধ এবং শিক্ষার ব্যাপার, দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার৷''
এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷