ইউরোপে বাংলাদেশের খাদ্য সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে: জয়নাল
১৭ নভেম্বর ২০১১মাতৃভূমি ছেড়ে হাজার মাইল দূরে থাকলেও দেশীয় খাবারের স্বাদ ভুলতে পারেন না কোন অভিবাসীই৷ তাই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ইউরোপেও দেশি খাবারের খোঁজে ঘোরে এশিয়ার মানুষ৷ এছাড়া এশিয়ার খাবারের স্বাদ আবার অনেক ইউরোপীয় এবং জার্মানদেরও পছন্দ৷ ফলে বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে ইউরোপে চলে আসছে টন টন শাক-সব্জি, মাছসহ বিশেষ খাদ্য সামগ্রী৷ আবার ইউরোপের খাদ্য সামগ্রীর তুলনায় সেগুলোর মূল্য কম হওয়ার কারণেও জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে এশীয় নানা খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা রয়েছে বেশ৷ তবে ইউরোপের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের খাদ্যপণ্য৷ এমন কথাই জানালেন ১৯৯৪ সাল থেকে জার্মানিতে আমদানি-রপ্তানির সাথে জড়িত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জয়নাল হক৷
জার্মানির বাণিজ্যিক নগরী ফ্রাঙ্কফুর্টে রয়েছে সী-ল্যান্ড নামে তাঁর আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান৷ জার্মানিতে বর্তমানে স্কয়ার গ্রুপের এজেন্ট৷ এছাড়া বরকত ও সুরভী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর ইউরোপীয় এজেন্ট হিসাবে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি৷ জার্মানির রাজধানী বার্লিন, মিউনিখ, ডর্টমুন্ড, অফেনবাখ সহ বিভিন্ন বড় বড় শহরে রয়েছে সী-ল্যান্ডের শাখা৷ এছাড়া বেলজিয়াম, হল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মিলান সহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এশীয় খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে এই প্রতিষ্ঠান৷
ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জয়নাল হক বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরণের শাক-সব্জি, চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ স্বল্প মূল্যে আমদানি করার ফলে এই অঞ্চলে সী-ল্যান্ড বেশ চমৎকার বাজার সৃষ্টি করেছিল৷ শুরুতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা সব্জির দাম ইউরোপের সব্জির চেয়ে অর্ধেক ছিল৷ এমনকি ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের অভিবাসীদের কাছেও আমাদের সব্জি খুব জনপ্রিয় ছিল এবং এখনও সমান চাহিদা রয়েছে৷ বার্লিন, মিউনিখ, বন থেকে শুরু করে প্রায় সব নগরীতেই একই রকম চাহিদা রয়েছে৷ কিন্তু মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের দিক থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য এখানে এখন টিকতে পারছে না৷ আমি বর্তমানে সপ্তাহে ২০ টন খাদ্য সামগ্রী বিশেষ করে সব্জি কেনাবেচা করি৷ কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করি মাত্র দুই টন৷ বাংলাদেশের পণ্যের আরো বেশি চাহিদা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এর চেয়ে বেশি আমদানি করা সম্ভব হয় না৷''
যে কোন দেশ থেকে জার্মানিতে পণ্য আমদানি করতে হলে এগুলোর গুণগত মান শতভাগ খাঁটি হতে হয়৷ কারণ প্রতিটি পণ্যের গুণগত উপাদান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় বলে উল্লেখ করেন জয়নাল হক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটি খাদ্য উপাদানের ব্যাপারে এতোটাই কড়াকড়ি করে যে, প্রতিটি সব্জি সর্বপ্রথম পরীক্ষাগারে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়, এতে কোন কীটনাশক আছে কি না, খাওয়ার উপযোগী কি না৷ যদি খাওয়ার অনুপযোগী হয় তাহলে প্রতিটি পণ্যের জন্য আমাদের দুই হাজার আটশ' ইউরো অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দুই লাখ আশি হাজার টাকা জরিমানা করা হয়৷ এছাড়া সেই পণ্য নষ্ট করে ফেলা হয় এবং কেন আমি এমন পণ্য আনলাম সেজন্য কৈফিয়ত দিতে হয়৷ অথচ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং দপ্তর পণ্যের গুণগত এই মান এতোটা নিশ্চিত করে না৷ ফলে ইউরোপ তথা জার্মানিতে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ তাই দেশের নেতা-নেত্রীদের প্রতি আমি আহ্বান জানাই যে, এদিকে তাঁদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত৷ কারণ সেক্ষেত্রে এই খাত থেকে বেশ মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে৷''
বাংলাদেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার উল্লেখ করেন জয়নাল হক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা যখন জিজ্ঞেস করি রপ্তানিকারককে যে, পণ্যের দাম এতো বেশি কেন? তখন তারা যেসব কারণ উল্লেখ করেন তার মধ্যে রয়েছে আইনি জটিলতা ও অসহযোগিতা৷ ফলে আমরা যেসব সব্জি ও পণ্য কলকাতা থেকে আমদানি করি, সেগুলো বৈধ লাভসহ যে দামে বিক্রি করতে পারি, বাংলাদেশ থেকে একই পণ্য আমদানি করলে তার দাম পড়ে প্রায় দশ শতাংশ বেশি৷''
বাংলাদেশের খাদ্য পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি জায়গায় হিমাগার স্থাপনের সুপারিশ করেন জয়নাল হক৷ এছাড়া চাষি যেন সরাসরি মাঠ থেকে সেই হিমাগারে তাদের পণ্য এনে রাখতে পারে এবং সেখান থেকে রপ্তানিকারক বিমানে করে কম সময়ে ইউরোপে পাঠাতে পারে সেক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷
তিনি আরো জানালেন, ‘‘বিশ্বের সব অঞ্চল থেকে জার্মানিতে লেবু আমদানি করা হয়৷ বাংলাদেশ থেকেও এখানে লেবু ও সাইট্রাস জাতীয় সব ফল আমদানি করা সম্ভব৷ অথচ দুঃখজনক ব্যাপার যে, ঢাকায় খামারবাড়িতে যে দপ্তর থেকে সব্জি দেশের বাইরে রপ্তানির জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়, তারা এখনও বলে যাচ্ছে যে ইউরোপে লেবু রপ্তানি করা নিষেধ৷ এ ব্যাপারে আমি ঢাকার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোন ফল হয়নি৷ আবার জার্মানির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে যোগাযোগ করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এবং তারাও বলছে যে,ইন্টারনেটে গিয়েই স্পষ্ট দেখা যেতে পারে যে এটি রপ্তানি করতে কোন বাধা নেই৷ তাই আমি ডয়চে ভেলের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাই যে, জার্মানিতে সব ধরণের লেবু রপ্তানির ব্যাপারে যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক