ইউরো সংকট নিয়ে নানা প্রশ্ন
২৩ জুন ২০১৩সাইপ্রাসের অর্থনীতির অধ্যাপক লুইস ক্রিস্টোফিডেস বলেন, তাঁর দেশে সংকট এসেছিল হঠাৎ করে৷ প্রথমে ব্যাংকিং ক্ষেত্র নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিল৷ কর ব্যবস্থায়ও ফাঁক দেখা দিয়েছিল৷ সাইপ্রাসে রাষ্ট্রের পরিষেবা খুবই সীমিত৷ ইউরোপের বাকি দেশের মতো নয়৷ তবে দেশের ব্যাংকিং পরিষেবা ছিল খুবই উন্নত৷ বিদেশ থেকে সহজেই মূলধন আসতে থাকায় অবশ্য কিছুটা ঔদ্ধত্য দেখা যাচ্ছিল৷ সরকারি বাজেটে ঘাটতি দেখা দিল, তার মাত্রাও বাড়তে থাকলো৷ এর দায় অবশ্যই দেশকে নিতে হবে, বাকিদের দায়ী করলে চলবে না৷
অধ্যাপক ক্রিস্টোফিডেস অবশ্য মনে করেন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইএমএফ – আন্তর্জাতিক দাতাদের এই ত্রিমূর্তিরও দোষ আছে৷ তাদের স্বার্থও ভিন্ন৷ তাঁর মতে, ইউরো এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলির সিদ্ধান্ত অসংলগ্ন৷ একই সপ্তাহের মধ্যে দুই বিপরীত নীতি চাপানো হলো সাইপ্রাসের উপর৷ ইউরো এলাকার কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্যও সাইপ্রাসের ক্ষতি করেছে৷ আচমকা অর্থ দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে৷ মোটকথা, তাঁর দেশ এই সব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে৷ তবে তাঁর প্রশ্ন, এর মূল্য কে বহন করবে? সবটাই কি সাইপ্রাসের দায়? সাইপ্রাসের মানুষের দুঃখ, তাদের দুর্দিনে বাকি ইউরোপ যথেষ্ট সংহতি দেখায়নি৷ তার উপর ইসিবি সাইপ্রাসের একটি ব্যাংককে জরুরি তহবিল থেকে কেন এত অর্থ নিতে দিয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ ‘গিনিপিগ' হিসেবে সাইপ্রাসের মানুষের মনে দুঃখ রয়েছে, বলেন অধ্যাপক ক্রিস্টোফিডেস৷ সাইপ্রাস ২০১২ সাল পর্যন্ত তার ব্যাংকিং মডেল চালিয়ে আসছিল৷ ততদিন মডেলটি প্রশ্নের মুখে পড়ে নি৷ এখন আরও পরিণতমনস্কতার প্রয়োজন৷
কয়েকজন বক্তা বললেন, গণতন্ত্রের সমস্যা হলো, আগামী প্রজন্মের অর্থ আজই খরচ করা যায়৷ ফলে পশ্চিমা গণতন্ত্রের সংকট দেখা যাচ্ছে৷ ২০০৮ সাল থেকে বাকিরা ভাবছে, এটাই সঠিক মডেল কি না৷ তবে সব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র কিছুটা ধীর গতি নেয়৷ চীনের মতো দ্রুত কিছু করে দেখানো কঠিন৷ এদিকে চীন বুঝতে পারছে না, ইউরোপ কেন একত্রে কাজ করছে না, পরস্পরকে সাহায্য করছে না৷ হতাশ হচ্ছে৷
সংকটের কারণে উত্তর ইউরোপের দেশগুলিকে ‘বেইল ইন' করতে হচ্ছে৷ তবে ব্যাংকিং ক্ষেত্রের উপর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন৷ বেলআউটের ফলে ব্যাংকগুলির শিক্ষাও হচ্ছে৷ সাহায্যের উপর নির্ভরতার ফলে তারা আর আগের মতো লাগামছাড়া আচরণ করতে পারছে না৷
ইউরো সংকটের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ৷ ইউরোপের অর্থোডক্স খ্রিষ্টান দেশগুলির কিছু বিশেষত্ব রয়েছে৷ খ্রিষ্টান ধর্মীয় মঠ যেভাবে মানুষের কাছ থেকে জিনিস সংগ্রহ করে, তার ফলে আলাদা মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে৷ বক্তাদের মতে, এই পার্থক্যের ভিত্তিতে ইউরোপে তিনটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জোন তৈরি হয়েছে৷ এদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করলেও লাভ হবে না৷ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা দাওয়াই চাই৷ ভাষাগত ভিন্নতা রয়েছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত যে যার সমস্যা, নিজেকেই তার সমাধান করতে হবে৷ গ্রিসে ধীরে পরিবর্তন ঘটছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের বদলাচ্ছে৷ সরকার ঠিক সময়ে কাজ শুরু করে নি৷ রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য এখনো শিক্ষা নেয় না৷
আলোচনাসভায় কয়েকজন বক্তা মনে করিয়ে দিলেন যে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ভুললেও চলবে না৷ যেমন জার্মানি বার বার মূল্যস্ফীতি দেখেছে৷ দক্ষিণ ইউরোপ মন্দায় ভুগেছে৷ ফলে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়৷ বর্তমানে জার্মানির মতো রাষ্ট্র দেশের মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারছে, দক্ষিণে যার অভাব রয়েছে৷
ইউরোপীয় স্তরেও গাফিলতির অভিযোগ উঠছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেক সময় নিয়েছে৷ কোনোরকমে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এই আশায় তারা ধীরে ধরে চলেছে, সময় নষ্ট করেছে৷ এখন বাকি ইউরোপের উপর জার্মান আর্থিক ও অর্থনৈতিক মডেল চাপানোর চেষ্টা চলছে – এমন অভিযোগ বার বার শোনা যাচ্ছে৷ বক্তাদের মতে, ভবিষ্যতে বিশেষ করে ব্যাংকের উপর আরও নিয়ম চাপাতে হবে৷ তা কার্যকরও করতে হবে৷