আরজি কর হাসপাতালে ডাক্তারকে ধর্ষণ-খুন, রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন
আরজি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুন। এক সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ধৃত। অধ্যক্ষের ইস্তফা। বিক্ষোভে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা।
হাসপাতালের ভিতরেই ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন
আরজি কর হাসপাতাল হলো উত্তর কলকাতার কেন্দ্রে। সেখানেই নাইট ডিউটির পর এক নারী জুনিয়র ডাক্তার হাসপাতালের চারতলায় সেমিনার রুমে গেছিলেন পড়াশুনো ও বিশ্রাম করতে। সেখানেই ধর্ষণের পর খুন করা হয় তাকে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ গোটা পশ্চিমবঙ্গ। মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন । প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ, প্রশাসন ও হাসপাতাল প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে।
অভিযুক্ত গ্রেপ্তার
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিয়োগে পুলিশ সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে। সিসিটিভির ফুটেজ ও ঘটনাস্থলে পাওয়া তার হেডফোন থেকে পুলিশ সঞ্জয়কে চিহ্নিত করে ও গ্রেপ্তার করে। ঘটনার রাতে সে আরজি কর-এ ছিল। বাইরে থেকে মদ খেয়ে গভীর রাতে সে হাসপাতালে ঢোকে এবং সেমিনার হলে চলে যায়। সেখানেই সে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা করে বলে অভিযোগ।
অভিযুক্তকে নিয়ে তোলপাড়
সঞ্জয় রায় ছিল সিভিক ভলান্টিয়ার। তাদের কাজ হলো পুলিশকে সহায়তা করা, মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া। এখানে নিরাপত্তা দেয়া দূরস্থান, সে এই নৃশংস কাজ করেছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ কমিশনার অবশ্য এই পেশার বিষয়টি এড়িয়ে বলেছেন, পরিবার চাইলে অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত করাতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী একই কথা বলেছেন। তবে তিনি সিবিআই তদন্তের অনুরোধ জানাননি। নিয়ম হলো, আদালত এই নির্দেশ দিতে পারে বা মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করতে পারেন।
হাসপাতালে নিরাপত্তা কোথায়?
ভয়ঙ্কর এই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি ধর্ষণ ও খুন করা হয়, তাহলে তো মেনে নিতে হবে, সেখানে কোনো নিরাপত্তাই নেই। কী করে অভিযুক্ত সেমিনার হলে গেল? কেন তাকে আটকানো হয়নি? কী করে তার অবাধ গতিবিধি ছিল? কেন সেমিনার রুমের ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা নেই?
প্রতিবাদ, আন্দোলন
এই ঘটনার প্রতিবাদে আরজি কর, ন্যাশনাল মেডিক্যাল, কলকাতা মেডিক্যাল ও এনআরএসে জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছেন। তারা জরুরি বিভাগের পরিষেবাও বন্ধ রেখেছেন। তাদের চার দফা দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে তারা জানিয়ে দিয়েছেন। জেলার হাসাপাতালের চিকিৎসকরাও আন্দোলন শুরু করেছেন।
দাবি মেনে অপসারণ, অধ্যক্ষের ইস্তফা
আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ''পড়ুয়ারারা আমার ইস্তফা চেয়েছিলেন। আমায় নানা কটূক্তি করা হয়েছে। আশা করি এবার জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্র-ছাত্রীরা কাজে ফিরবেন।'' তবে তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে ধর্ষিতার নাম নিয়ে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এর আগে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে এসিপি নর্থকে সরিয়ে দেয় সরকার।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে
আন্দোলনকারীদের দুইটি দাবি মানা হলেও ময়না তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি মানা হয়নি। ফলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনের পরিধি বাড়ছে। আন্দোলনরতরা জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো দলের পতাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা যাবে না। কোনো নেতা এলে দলীয় পতাকা, স্লোগান ছাড়া আসতে হবে।
অভিযুক্তের ফাঁসি দাবি
আন্দোলনকারীরা দাবি করেছেন, দোষীকে ফাঁসি দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিনিও চান দোষীর সর্বোচ্চ সাজা হোক। পুলিশ কমিশনারও সর্বোচ্চ সাজা চাইছেন। তা সত্ত্বেও পুলিশের ভূমিকার প্রবল সমালোচনা চলছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও একই দাবি করেছে।
অপর্ণা সেনের প্রশ্ন
অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ''পুলিশ কী করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারে? তারা কী করে রক্তক্ত দেহ দেখার পরও বললো আত্মহ্যার ঘটনা?'' তার দাবি, ''পুলিশের ভূমিকা সন্দেহমুক্ত নয়। তার তদন্ত করতে হবে।''
পুলিশের আবেদন
কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে ফেসবুক পোস্ট করে সবাইকে তাদের উপর ভরসা রাখার আবেদন জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে তদন্ত হচ্ছে। কলকাতা পুলিশ দ্রুত চার্জশিট দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে বলেও জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোববারের মধ্যে কিনারা না হলে তিনি সিবিআই তদন্তের অনুরোধ জানাবেন।
দলগুলির বিক্ষোভ চলছে
বিরোধী দলগুলিও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নেমেছে। বাম ছাত্র-যুব নেতারা আরজি কর-এ গেছিলেন। পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়েছে।বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পালও আরজি কর-এ যান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাড্ডাকে অনুরোধ করেছেন, তিনি যেন আরজি কর হাসপাতালের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখেন। তিনি সিবিআই তদন্তের দাবিও করেছেন।
চার ডাক্তারকে নোটিশ
পুলিশ চার ডাক্তারকে নোটিশ পাঠিয়েছে। তারা ধর্ষিতা ও খুন হয়ে যাওয়া নারী চিকিৎসকের সঙ্গে নৈশভোজ করেছিলেন। অ্যাপের মাধ্যমে তারা কাবার আনিয়েছিলেন। ওই চারজনের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক একজন হাউসস্টাফ। এই ধর্ষণ ও হত্যার পিছনে আর কারো হাত আছে কিনা, তা পুলিশ খতিয়ে দেখতে চাইছে।
হাসপাতালের অবস্থা নিয়ে
কলকাতার সরকারি হাসপাতালের নৈরাজ্য, দালালরাজ, অব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে কোনো গোলমাল হলে হইচই শুরু হয়। তারপর পরিস্থিতি আবার আগের চেহারায় পিরে যায় বলে অবিযোগ। এর মধ্যে গত জুলাইতে সিবিক ভলেন্টিয়াররা রোগীর আত্মীয়কে বেধড়ক মারধর করেছিলেন। তা নিয়ে হইচই হলেও এই সিভিক ভলেন্টিয়ারদের প্রতাপ কম হয়নি বলে রোগীর আত্মীয়রা অভিযোগ করেন।