‘‘আম আদমি পার্টি''
১১ ডিসেম্বর ২০১৩দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল তখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ শাসকদল কংগ্রেস ধুয়ে মুছে প্রায় সাফ৷ ভোটের দৌড়ে এগিয়ে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি, কিন্তু তাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে আম আদমি পার্টি নামে মাত্র এক বছরের পুরনো, প্রায় অপরিচিত একটি দল৷ শেষ ফলাফল, ত্রিশঙ্কু বিধানসভা৷ বিজেপি একক গরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসন পায়নি৷ কংগ্রেস দূরতম তৃতীয় অবস্থানে এবং বিজেপির থেকে মাত্র চারটি আসন কম পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আম আদমি পার্টি৷ টিভি চ্যানেলগুলোতে তখন শুধুই আম আদমি পার্টির দিল্লির সদর দপ্তরের সামনে দলের কর্মী-সমর্থকদের উল্লাসের ছবি৷ হাজার হাজার হাতে আন্দোলিত হচ্ছে ঘর সাফ করার ঝাঁটা! শুনতে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, ভারতের সদ্যোজাত এই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রতীক ছিল এটাই – ঝাঁটা বা ঝাড়ু৷ দেশ থেকে সমস্ত দুর্নীতি আর ভ্রষ্টাচার ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে যে দলের পত্তন৷
ভারতীয় রাজনীতিতে যেখানে আদর্শ এবং মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে স্রেফ ক্ষমতা এবং অর্থ হাসিল করাটাই দস্তুর, সেখানে আম আদমি পার্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন এক মূর্তিমান কালাপাহাড়৷ রাজনীতির প্রচলিত সমস্ত নীতিহীনতা আর ভ্রষ্টাচারকে তারা চ্যালেঞ্জ করবে এবং ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে সুবিধাবাদী, মুনাফালোভী অচলায়তনকে৷ ভারতের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত নড়ে গিয়েছে আম আদমি পার্টির আপোসহীন মনোভাবে৷ তার সবথেকে বড় প্রমাণ, দিল্লির ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় কোনও দল সরকার গঠন করতে এখন উৎসাহী নয়৷ অন্য সময় হলে, এ ধরনের ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে মুহূর্তে শুরু হয়ে যেত দল ভাঙাভাঙির রাজনীতি৷ এবারেও যে চেষ্টা হয়নি তা নয়৷ আম আদমি পার্টির কয়েকজন নির্বাচিত বিধায়কের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল বিজেপি৷ কিন্তু আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল সংবাদমাধ্যমের সামনে সে কথা ফাঁস করে দেওয়ায় দল ভাঙার সেই চেষ্টা পন্ড হয়৷ ফলে দিল্লি সম্ভবত আবার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে৷ কারণ, আম আদমি পার্টির সততা বিধায়ক কেনাবেচার চিরন্তন খেলায় বাদ সেধেছে৷
অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর দলের নির্বাচনি সাফল্যের কারণ হিসেবে ঠিক এই কথাটাই বলেছেন যে, এই প্রথম ভারতে কেউ মূল্যবোধের রাজনীতির কথা বলল৷ এই প্রথম কোনও দল বলল, তারা সরকারে যেতে, ক্ষমতা দখল করতে আগ্রহী নয়৷ রাহুল গান্ধী না নরেন্দ্র মোদি, কে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না৷ তারা কেবল চায় দেশ থেকে দুর্নীতি আর ভ্রষ্টাচার বিদায় হোক, জিনিসপত্রের দাম কমুক, সাধারণ মানুষ, দেশের আম আদমি একটু ভালভাবে বেঁচে থাকুক৷ ঠিক যেটা আমজনতার মনের কথা৷ সম্ভবত আম আদমি পার্টির এই আন্তরিকতা দেখেই অসংখ্য অনাবাসী ভারতীয়, যাঁরা অনেকেই উপযুক্ত সুযোগের অভাবে, অথবা দেশের রাজনীতিকদের অসততা আর দুর্নীতিতে হতাশ হয়ে, দেশ ছেড়ে বিদেশে বাসা বেঁধেছেন, তাঁরা এসে আম আদমি পার্টির পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ আর দেশের মধ্যেও বহু সফল, লব্ধপ্রতিষ্ঠ পেশাদার, অনেকেই নিজেদের চাকরিবাকরি ছেড়ে আম আদমি পার্টির স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গিয়েছেন৷
আম আদমি পার্টি কীভাবে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার করেছিল, সেদিকে একটু নজর দিলেই বোঝা যাবে, আদতেই আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এদের গুলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না৷ বড় দলগুলোর মতো বিরাট অঙ্কের চাঁদা পাওয়ার যোগ্যতা নেই বা শিল্পপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তবু যে কংগ্রেস এবং বিজেপির সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে গেল আম আদমি পার্টি, তার একমাত্র কারণ এই দলের জনশক্তি আর তার সংকল্প এবং আন্তরিকতা৷ মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য, তাঁদের কথা শোনার জন্য এবং বলার জন্য সত্যিই সচেষ্ট হয়েছিলেন কর্মীরা৷ নির্বাচনের ছ মাস আগে থেকে দেশে ও বিদেশে একটি মোবাইল নম্বর ছড়িয়ে দিয়েছিল আম আদমি পার্টি, শুধু এটাই জানতে চেয়ে যে, লোকে এই পার্টির কাছ থেকে কী চায়? কোন কথাটা জানাতে চায়? দিনে গড়ে ১০০টা ফোন আসত দেশ এবং বিদেশ থেকেও, জানিয়েছেন দলের কর্মীরা৷ এছাড়া নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই দিল্লির মেট্রো স্টেশনগুলোতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চলে যেতেন কর্মীরা৷ পালা করে যাত্রীদের বোঝাতেন, কী উদ্দেশ্যে তাঁদের লড়াই৷
আইআইটি কানপুর থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার নন্দন মিশ্র৷ নিজের বড় অঙ্কের বেতনের বাঁধা চাকরি ছেড়ে দিয়ে আম আদমি পার্টির স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গিয়েছিলেন৷ তিনি একটি গানের দল বা ব্যান্ড তৈরি করেছিলেন আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে৷ ভোটের আগে দিল্লি বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে ওঁরা গান গাইতেন, জনসমর্থন আদায় করতেন৷ নন্দন একা নন, তাঁর মতো আরও অনেক ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, তথ্য-প্রযুক্তি পেশাদার, ব্যবসায়ী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী নিজেরা এসে যোগ দেন আম আদমি পার্টির স্বেচ্ছাসেবক হয়ে৷ সাত-আট মাস ধরে এঁরা নেপথ্যে থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন৷ এখানে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের যেখানে নিয়োগ দেয়া হয় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে থেকে, সেখানে আম আদমি পার্টির কর্মীরা সবাই যে যাঁর পেশায় নিযুক্ত৷ অর্থাৎ ওঁদের কারোরই পেশা রাজনীতি নয়৷ রাজনৈতিক দল বা নেতাদের প্রয়োজনে ওঁরা ভাড়া খাটেন না৷ ওঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের অন্তরের তাগিদ থেকে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে এসেছেন৷ ঠিক যেমন একদিন এগিয়ে এসেছিলেন অরবিন্দ কেজরিয়াল, যিনি আইআইটি খড়গপুর থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর রাজস্ব বিভাগে যোগ দিয়ে আয়কর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার পদে উন্নীত হয়েছিলেন৷ ২০০৬ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিবান নবীন নেতা হিসেবে৷
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির সাফল্যের পর এখন ভারতের নানা জায়গা থেকে দলের শাখা খোলার খবর আসছে৷ হরিয়ানায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুদা-র নিজের শহর রোহটাক-এ রাতারাতি আম আদমি পার্টির একটি শাখা তৈরি হয়েছে৷ কেরলের কোচিতে আম আদমি পার্টির ব্যানারে স্থানীয় মানুষ বিতর্কিত আরানমুলা বিমানবন্দর প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ কলকাতায় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের একদল ছাত্র আম আদমি পার্টির হয়ে প্রচার শুরু করছে৷ খড়গপুর আইআইটির একজন ছাত্রের কথা জানা গিয়েছে, যিনি নিজের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পেশা ছেড়ে আম আদমি পার্টির স্বেচ্ছাসেবক হবেন বলে নাম লিখিয়েছেন৷ তাঁর আদর্শ? অবশ্যই অরবিন্দ কেজরিওয়াল!